দীনুদাদুর আজব
জন্তু' তপন কুমার বন্দ্যোপাধ্যায়
গল্পটা শুনেছিলাম আমার মায়ের দূরসম্পর্কের এক পিসতুত মামার মুখে।আজ থেকে প্রায় চল্লিশ বছর আগে। দীনু দাদু বলেই ডাকতাম ।তিনি পুর্ব বঙ্গের মানুষ ছিলেন। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ থেকে এদেশে এসেছিলেন ,বিয়ে থা করেননি , সারা পৃথিবী জুড়ে বেড়ানোর নেশা।উনি পেশায় ছিলেন শিক্ষক,যা উপার্জন করতেন সব জমিয়ে বছরে ৩ বার ঘুরতে বেরুতেন।ওনার পৃথিবীর সব মহাদেশে যাওয়া হয়ে ওঠেনি। ১৯৮৬ সালে মারা যান ৮৬ বছর বয়সে।উনি আফ্রিকায় বেড়াতে গিয়ে কেনিয়ার জঙ্গলে এক বিস্ময়কর জন্তুর সন্ধান পেয়ে ছিলেন।যার বিবরণ কোথাও কখনো পাননি। পরবর্ত্তী কালে উনি বহু জীব বিজ্ঞানীর নিকট চিঠি চাপাটি করেও কোন সঠিক উত্তর পাননি সকলেই গালগল্প হিসাবে উড়িয়ে দিয়েছেন।এক মাত্র রাশিয়ান জীব বিজ্ঞানী ডক্টর এমুরাস স্কোভিক জানিয়েছিলেন,এই রকম জন্তু তিনি কখনো দেখেন নি বা কোন বইতেও পড়েন নি,তবে এই জানিনা,জানলেও গুরুত্ব দিয়ে কোন রকম অনুসন্ধান বা গবেষণা করা হয়না, ফলে অজানাই থেকে যায় এই সব বিশ্বের বিষ্ময়। আমি অনেক গল্প ই দীনুকাকার মুখে শুনেছি।উনি কিছু তাঁর শোনা কাহিনী কিছু তার নিজের চোখে দেখা কাহিনী।দীনু কাকার কছে যেমন শুনেছি তার নিজের মুখে বলা বর্ণনা ভাবেই লেখার চেষ্টা করছি, জানিনা কতদুর সঠিক ভাবে বর্ণনা করতে পারব,অথচ এই কাহিনী আজ ও আমার কানের কাছে বাজছে।আমি বিস্মিত হতবাক হয়ে মুগ্ধভাবে শুনেছি।
পানীয় জলের সরবরাহ করবার জন্য আফ্রিকায় কেণিয়া, উগাণ্ডায় যেতে হয়ে ছিলো। যেহেতু আমাদের কোম্পানী সারাভাই এণ্টারপ্রাইসেস এই পানীয় জল সরবরাহ ব্যবস্থার কারিগরি প্রযুক্তি ও সম্পন্ন করার কাজের দায়িত্ব পেয়েছিলো।আমায় উগাণ্ডায় কাম্পেলা শহরে কাজ হয়ে যাবার পর পর ই হাঁটা পথে ঘন জঙ্গলের মধ্য দিয়ে ভিক্টোরিয়া হ্রদ দেখার জন্য ভীষণ ইচ্ছা হয়।আমার সাথী চেন্নাই এর ভেঙ্কটেশ গণেশন আমার বাসনার কথা শুনে সঙ্গে যাবার জন্য তক্ষুণি তৈরী হয়ে ব্যস্ত হয়ে তাগিদা দিতে শুরু করল। আমি ওকে পথের বিপদ সঙ্কুলতার কথা বললাম,ঘন জঙ্গল, অজানা ভয়ঙ্কর বিপদ ঘনিয়ে আসতে পারে কোন ধারনাই নেই।হিংস্রজন্তু আর সাপ খোপ ভরা গভীরজঙ্গল। মাঝে মাঝে পাহার ও আছে।পাহার জঙ্গল ধাপে ধাপে সমতলে নেমে এসে মিশেছে। অনেক জায়গায় জঙ্গল এমন গভীর, গাছপালা আকাশ ঢেকে রেখেছে-দিনের বেলায় ও রোদ পৌঁছায়না মাটিতে।আমরা শুকনো খাবার,ঔষধপত্র,ছুরি কাঁচি,টর্চ,আর আমার আত্মরক্ষার্থে একটা রিভলভার নিয়ে বেড়িয়ে পড়লাম।প্রথমে হালকা ঘনত্বের জঙ্গল তারপর ক্রমশঃ গভীর হতে লাগলো।পায়ে হাঁটু অবধি জঙ্গলে হাঁটার জন্য হান্টার সু গাম বুট।কোন সরিসৃপ প্রাণী যাতে চট করে হাঁটুর নীচে কামড়াতে না পারে।ঝড়াপাতা আর বুনো ঘাসের মধ্য দিয়ে চলতে হচ্ছে-মচমচ শব্দ হচ্ছে।ভিক্টোরিয়া পৌঁছতে ১৬-১৭ ঘণ্টা লেগে যেতে পারে, জঙ্গলের পথে প্রায় ৮০ কিলোমিটার যেতে হবে- মাঝে মাঝে গভীর জঙ্গল।বিকাল ৩-৪টার সময় একটা অপেক্ষাকৃত ফাঁকা জায়গা যেখানে বড় বড় ডালপালা ছড়ানো গাছ আছে এমন জায়গায় উপস্থিত হলাম।এই পর্য্যন্ত আসার পথে ,বহু সরীসৃপ জাতীয় প্রাণী,চিনিনা এমন কালচে চাকাচাকাদাগ হাত ৪/৫লম্বা সাপ, সজারুর মতন প্রাণী ,কিছু বড়বড় ইঁদুর জাতীয় প্রাণী,খরগোশ এগুলো দেখলাম।রাত্রে থাকার ব্যবস্থা করতে হবে।একটা আমাদের দেশের আমগাছের মতন গাছ বেছে নিয়ে বেশ খানিকটা উঠে উঁচুতে টুকরো ডাল বেঁধে মাচা মতন বানালাম রাতটা দুজনে ঐ মাচায় বসেই কাটাবো।জোরালো সাত সেলের টর্চ, রিভলবার, খাবার জলের বোতল,ধারালো বড় ছুড়ি সব হাতের কাছেই সাইড ব্যাগে রাখলাম।আধ ঘণ্টার মধ্যে ঝুপ করে অন্ধকার নেমে এলো।চারপাশে ঘন অন্ধকারে ঢাকতেই জোনাকি জ্বলছে ,কিচির মিচির শব্দ গাছের মাথায় পাখীরা বাসায় ফিরে এসেছে আগেই।জঙ্গলের মধ্যে আজানা সব পশুদের ডাক,দুরে একটা ঝটাপটির শব্দ মনে হয় কোন জন্তু শিকার ধরেছে।আমরা দুজনেই বেশ সজাগ, নিজেদের গাছের ডালের সাথে বেঁধে নিয়েছি যাতে চোখে ঘুম এলে ঢুলে পড়ে না যাই।হাতের রিস্টোয়াচে রেডিয়াম দেওয়া অন্ধকারে জ্বলজ্বল করে কটা বাজে বোঝা যায়।জঙ্গলের মধ্যে প্রচণ্ড ভয় আর আতঙ্ক,আমরা কেউ আগে কখন ও এভাবে জঙ্গলে থাকিনি।বেড়াতে গিয়ে জঙ্গলে থাকা, নাইট সাফারির অভিজ্ঞতা থাকলেও সে অনুভুতি আর এইভাবে অপরিচিত ভয়ঙ্কর জঙ্গলে খোলা আকাশের নীচে গাছে রাত কাটানো-সম্পুর্ণ আলাদা অভিজ্ঞতা।
তখন প্রায় রাত আড়াইটে বাজে-হঠাৎ ভয়ঙ্কর ভাবে গাছে থাকা পাখীরা আর বাঁনর গুলো চেঁচামেচি হুটোপাটি শুরু করল।আমি শিকার কাহিনীতে জঙ্গলের পশুদের আচার আচরণ পড়ে জেনেছি যে কোন ভয়ঙ্কর, হিংস্র জন্তু জানোয়ার দেখলে, কাছাকাছি কোথাও এলে পাখি, বানর এরকম প্রাণীরা ভয়ে চেঁচামেচি করে,ডাকে-সকল কে সতর্ক করে দেয়।এদিকটায় বাঘ,সিংহ আছে কিনা আমার জানা নেই, তবে স্থানীয় লোকেদের মুখে শোনাযায় যে বাঘ, সিংহ এদিকটায় নেই বললেই চলে তবে ভয়ংকর 'বুগুডুম্পা'র সন্ধান মেলে, সেপ্রাণী আরো মারাত্মক খুউব ই ভয়ঙ্কর। বুগুডুম্পা কি? জানতে চাইলাম-এ সাক্ষাৎ শয়তান-প্রাণী না উদ্ভিদ কেউ জানেনা-স্থানীয় আদিবাসীরা বলে এ সাক্ষাৎ শয়তান বহুরুপী,কখন ও গাছ, কখন ও গাছের ডাল ,কখন মাছ, ডাঙ্গায় কোন বন বিড়ালের মতন জন্তু, কখন ও বুকে হাঁটা গোসাপের মতন, কখন ও নিছক নিস্প্রাণ পাথরের ঢিবির মতন নানা রুপ আকৃতি ধারন করে। আসলে সে সব রুপ ধরতেই সক্ষম। চারপাশের সাথে গিরগিটি,বহুরুপীর মতন রঙ বদলায়।প্রচণ্ড হিংস্র। বড়বড় জন্তু যেমন বুনো মোষ,সিংহ,হাতির মতন বড়বড় প্রাণীর দেহ থেকে খামচে,কামড়ে মাংস খেয়ে নেয়।ঐ প্রাণীরাও বুগুডূম্পার আক্রমণে মারা যায়। তাই সবাই ভীষণ ভয় পায় আতঙ্কে থাকে। এই প্রাণীর দেখা পাওয়া দুষ্কর । দিনের বেলা এরা কখনো আক্রমণ করেনা, ঘুমায়। এক জায়গায় হয়ত পাথরের সাথে মিশে বা গাছের ঝোঁপে কোন গাছ যেমন ফণী মনসা রুপ ধরে,চেনা যায়না ফলে কেউ দেখেছে এদের কাছ থেকে কিম্বা ছবি তুলেছে বলে জানা যায়নি। তবে অনেক শিকারি,অনেক আদিবাসী এদের অস্তিত্ব বুঝতে পেরেছে-দুর থেকে দেখেছে কিন্তু কিছুই করতে পারিনি। মনে হয় এই প্রাণী অনান্য প্রাণীর অস্তিত্ব দূর থেকে বুঝতে পারে।আরো বুঝতে পারে প্রাণীটি কি প্রকৃতির, বিপদ বুঝলে লুকিয়ে পড়ে,নিজেকে ক্যামোফ্লেজ করে,নইলে আক্রমণ করে।ছোট ছোট পোকামাকড় ,জন্তু জানোয়ার ধরে খায় তার কোনো অবশেষ পড়ে থাকেনা।এরা গাছ পালার আড়ালে,পাহাড়ের গর্ত্তে লুকিয়ে থাকে।বহু তন্ন তন্ন করে খুঁজেও অনুসন্ধান করেও হদিশ পাওয়া যায়নি। এজন্য বুগুডুম্পা একটা রুপ কথার কাল্পনিক প্রাণী, অলীক বস্তু বলেই সবার বিশ্বাস।
পাখীর আর বাঁদরের কিচিমিচি ,হৈ চৈতে সতর্ক হয়ে চারপাশে তন্ন তন্ন করে খুঁটিয়ে দেখতে লাগলাম। আমাদের দুজনের কাছেই' নাইট ভিশন ' দুরবীন আছে রাত্রেও স্পষ্ট দেখতে পাওয়া যায়,এগুলো ইনফ্রা রেড আলোয় দেখা যায়,সেনা বাহিনীর কাছে থাকে। আমরা দুটো বন্ধুর কাছ থেকে জোগার করে নিয়ে এসেছি।ফিরে গিয়ে ফেরৎ দিয়ে দেব।
হঠাৎ দেখি জঙ্গলের এক প্রান্ত যে দিকটা অপেক্ষাকৃত ফাঁকা পাহাড়ের ঢাল এসে সমতলে মিশেছে,ছোট ছোট গাছের ঝোঁপ, বড়বড় পাথরের খণ্ড ইতঃস্তত ছড়িয়ে আছে সেখানে। বোধহয় দিনটাছিলো পূর্ণিমা-চাঁদের আলো এসে ঐ ফাঁকা জায়গাটাতে পড়েছে, দিনের মতনই স্পষ্ট দেখাযাচ্ছে চারপাশ।দেখলাম একটা ডিমের মতন পাথরের খণ্ড গড়িয় গড়িয়ে জঙ্গলেরই একপাশে আসছে। পাথরের খণ্ডটা বেশ মাঝারি উচ্চতার চার ফ্যটের মতন লম্বা আর ফুট তিনেক চওড়া।কোন জন্তু হবে হাত পা মুখ কিছুই নেই। খণ্ডটার উপর দিকে দুটো বড়বড় চাকার মতন গোল লাল আলো জ্বলছে। তীব্র আলো নয়-অনেকটা নিভন্ত কয়লার মতন। বুঝলাম এটা নিশ্চয় কোন জন্তুই হবে।চোখের ঐ লাল আভা-এর একটু নীচে একটা গর্ত মতন যেখান দিয়ে মাঝে মাঝে একটা সাপের জিভের মতন সরু লিক লিকে চেরা জিভ বেরুচ্ছে। লক লক চারপাশে ঘুরে আবার সাপের জিভের মতন ই ঢুকে যাচ্ছে।ওটাই বোধ হয় শ্বাস প্রশ্বাস নেবার জন্য,অথবা খাদ্যের অনুসন্ধানের জন্য।ঐ প্রাণীটি বা বস্তুটি মাটি দিয়ে গড়িয়ে আসার মতন আসছে ধীরে ধীরে।
খুউব মনযোগ সহকারে লক্ষ্য করছিলাম- ভয়ে আতঙ্কে নিঃশ্চুপ। আমাদের থেকে হাত পঞ্চাশেক দুরে যখন তখন দেখি ঐ জন্তুটার ভাল্লুকের মতন সারা দেহ ঘন কালো লোমে ঢাকা, পায়ের ওখানে গোল বলের মতন খেলনা গাড়ির চাকা লাগানো।ঐ বলের মতন অংশটা ঘুরছে আর জন্তুটা চলা ফেরা করছে। হঠাৎ জঙ্গলের ভেতর থেকে মর মর করে শুকনো পাতার ওপর দিয়ে কোন জন্তু বা কিছুর হেঁটে আসার শব্দ শুনতে পেলাম-আর অবাক কাণ্ড ঐ গোলাকার জন্তুটা মুহুর্তে উধাও হয়ে গেলো,ঐ জায়গায় একটা ফুট চারেকের কাঁটা ফণী মনসার মতন গাছ দাঁড়িয়ে। আমরা অবাক বিস্ময়ে হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে আছি, এমন সময় দেখি জঙ্গলের মধ্যে থেকে একটা বুনো শুয়োরের মতন প্রাণী তবে ঠিক কি প্রাণী বুঝতে পারলামনা -ধারালো দুটো দাঁট আছে, বুঝলাম খুউব ই হিংস্র প্রকৃতির প্রাণী ক্ষিপ্র গতিতে জঙ্গল থেকে বেড়িয়ে ঐ মনসা গাছটার কাছে আসতেই মনসা গাছটা সপাটে প্রাণীটাকে জাপ্টে ধরলো।তারপর দেখি কোথায় মনসা গাছ?প্রাণীটাকে ঢেকে রেখেছে একটা গাঢ় খয়েরী রং এর চাদর।তারপর? কিছুক্ষণ বাদে দেখি ওটা আবার পাথরের খণ্ডের মতন হয়ে গেছে- আর গড়িয়ে গড়িয়ে পাহাড়ের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। আমি হিতা হিত ভুলে গিয়ে রিভাল্ভারটা নিয়ে মুহুর্তে গুলি চালিয়ে দিলাম পরপর ।টং করে একটা ধাতব শব্দ শুনলাম, তারপর দেখি ঐ পাথরের খণ্ড মুহুর্তে প্রকাণ্ড পাখী প্রাগৈতিহাসিক যুগের টেরোডাকটাইলের (বইতে চবি দেখেছি )মত হয়ে সোঁ সোঁ করে ডানা ঝাপটিয়ে উড়ে চলে গেলো পাহাড়ের দিকে।মুহুর্তে অদৃশ্য হয়ে গেলো।
লোকশ্রুতি সত্যই বুগুডুম্পা আছে-আর তার অদ্ভুত ভৌতিক আচরণ । আমার কথা সভ্য জগতে কেউ বিশ্বাস করবেনা, করেওনি -তাই নানা উপহাস আর বিদ্রুপ শুনেছি-কেউ কেউ বলেছে আমি নেশাগ্রস্থ ছিলাম,কেউ বলেছে আতঙ্কে কল্পনায় মরিচিকা দেখেছি। আমার সাথী আর আমি দুজনেই দেখেছি।
গল্পটা শুনেছিলাম আমার মায়ের দূরসম্পর্কের এক পিসতুত মামার মুখে।আজ থেকে প্রায় চল্লিশ বছর আগে। দীনু দাদু বলেই ডাকতাম ।তিনি পুর্ব বঙ্গের মানুষ ছিলেন। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ থেকে এদেশে এসেছিলেন ,বিয়ে থা করেননি , সারা পৃথিবী জুড়ে বেড়ানোর নেশা।উনি পেশায় ছিলেন শিক্ষক,যা উপার্জন করতেন সব জমিয়ে বছরে ৩ বার ঘুরতে বেরুতেন।ওনার পৃথিবীর সব মহাদেশে যাওয়া হয়ে ওঠেনি। ১৯৮৬ সালে মারা যান ৮৬ বছর বয়সে।উনি আফ্রিকায় বেড়াতে গিয়ে কেনিয়ার জঙ্গলে এক বিস্ময়কর জন্তুর সন্ধান পেয়ে ছিলেন।যার বিবরণ কোথাও কখনো পাননি। পরবর্ত্তী কালে উনি বহু জীব বিজ্ঞানীর নিকট চিঠি চাপাটি করেও কোন সঠিক উত্তর পাননি সকলেই গালগল্প হিসাবে উড়িয়ে দিয়েছেন।এক মাত্র রাশিয়ান জীব বিজ্ঞানী ডক্টর এমুরাস স্কোভিক জানিয়েছিলেন,এই রকম জন্তু তিনি কখনো দেখেন নি বা কোন বইতেও পড়েন নি,তবে এই জানিনা,জানলেও গুরুত্ব দিয়ে কোন রকম অনুসন্ধান বা গবেষণা করা হয়না, ফলে অজানাই থেকে যায় এই সব বিশ্বের বিষ্ময়। আমি অনেক গল্প ই দীনুকাকার মুখে শুনেছি।উনি কিছু তাঁর শোনা কাহিনী কিছু তার নিজের চোখে দেখা কাহিনী।দীনু কাকার কছে যেমন শুনেছি তার নিজের মুখে বলা বর্ণনা ভাবেই লেখার চেষ্টা করছি, জানিনা কতদুর সঠিক ভাবে বর্ণনা করতে পারব,অথচ এই কাহিনী আজ ও আমার কানের কাছে বাজছে।আমি বিস্মিত হতবাক হয়ে মুগ্ধভাবে শুনেছি।
পানীয় জলের সরবরাহ করবার জন্য আফ্রিকায় কেণিয়া, উগাণ্ডায় যেতে হয়ে ছিলো। যেহেতু আমাদের কোম্পানী সারাভাই এণ্টারপ্রাইসেস এই পানীয় জল সরবরাহ ব্যবস্থার কারিগরি প্রযুক্তি ও সম্পন্ন করার কাজের দায়িত্ব পেয়েছিলো।আমায় উগাণ্ডায় কাম্পেলা শহরে কাজ হয়ে যাবার পর পর ই হাঁটা পথে ঘন জঙ্গলের মধ্য দিয়ে ভিক্টোরিয়া হ্রদ দেখার জন্য ভীষণ ইচ্ছা হয়।আমার সাথী চেন্নাই এর ভেঙ্কটেশ গণেশন আমার বাসনার কথা শুনে সঙ্গে যাবার জন্য তক্ষুণি তৈরী হয়ে ব্যস্ত হয়ে তাগিদা দিতে শুরু করল। আমি ওকে পথের বিপদ সঙ্কুলতার কথা বললাম,ঘন জঙ্গল, অজানা ভয়ঙ্কর বিপদ ঘনিয়ে আসতে পারে কোন ধারনাই নেই।হিংস্রজন্তু আর সাপ খোপ ভরা গভীরজঙ্গল। মাঝে মাঝে পাহার ও আছে।পাহার জঙ্গল ধাপে ধাপে সমতলে নেমে এসে মিশেছে। অনেক জায়গায় জঙ্গল এমন গভীর, গাছপালা আকাশ ঢেকে রেখেছে-দিনের বেলায় ও রোদ পৌঁছায়না মাটিতে।আমরা শুকনো খাবার,ঔষধপত্র,ছুরি কাঁচি,টর্চ,আর আমার আত্মরক্ষার্থে একটা রিভলভার নিয়ে বেড়িয়ে পড়লাম।প্রথমে হালকা ঘনত্বের জঙ্গল তারপর ক্রমশঃ গভীর হতে লাগলো।পায়ে হাঁটু অবধি জঙ্গলে হাঁটার জন্য হান্টার সু গাম বুট।কোন সরিসৃপ প্রাণী যাতে চট করে হাঁটুর নীচে কামড়াতে না পারে।ঝড়াপাতা আর বুনো ঘাসের মধ্য দিয়ে চলতে হচ্ছে-মচমচ শব্দ হচ্ছে।ভিক্টোরিয়া পৌঁছতে ১৬-১৭ ঘণ্টা লেগে যেতে পারে, জঙ্গলের পথে প্রায় ৮০ কিলোমিটার যেতে হবে- মাঝে মাঝে গভীর জঙ্গল।বিকাল ৩-৪টার সময় একটা অপেক্ষাকৃত ফাঁকা জায়গা যেখানে বড় বড় ডালপালা ছড়ানো গাছ আছে এমন জায়গায় উপস্থিত হলাম।এই পর্য্যন্ত আসার পথে ,বহু সরীসৃপ জাতীয় প্রাণী,চিনিনা এমন কালচে চাকাচাকাদাগ হাত ৪/৫লম্বা সাপ, সজারুর মতন প্রাণী ,কিছু বড়বড় ইঁদুর জাতীয় প্রাণী,খরগোশ এগুলো দেখলাম।রাত্রে থাকার ব্যবস্থা করতে হবে।একটা আমাদের দেশের আমগাছের মতন গাছ বেছে নিয়ে বেশ খানিকটা উঠে উঁচুতে টুকরো ডাল বেঁধে মাচা মতন বানালাম রাতটা দুজনে ঐ মাচায় বসেই কাটাবো।জোরালো সাত সেলের টর্চ, রিভলবার, খাবার জলের বোতল,ধারালো বড় ছুড়ি সব হাতের কাছেই সাইড ব্যাগে রাখলাম।আধ ঘণ্টার মধ্যে ঝুপ করে অন্ধকার নেমে এলো।চারপাশে ঘন অন্ধকারে ঢাকতেই জোনাকি জ্বলছে ,কিচির মিচির শব্দ গাছের মাথায় পাখীরা বাসায় ফিরে এসেছে আগেই।জঙ্গলের মধ্যে আজানা সব পশুদের ডাক,দুরে একটা ঝটাপটির শব্দ মনে হয় কোন জন্তু শিকার ধরেছে।আমরা দুজনেই বেশ সজাগ, নিজেদের গাছের ডালের সাথে বেঁধে নিয়েছি যাতে চোখে ঘুম এলে ঢুলে পড়ে না যাই।হাতের রিস্টোয়াচে রেডিয়াম দেওয়া অন্ধকারে জ্বলজ্বল করে কটা বাজে বোঝা যায়।জঙ্গলের মধ্যে প্রচণ্ড ভয় আর আতঙ্ক,আমরা কেউ আগে কখন ও এভাবে জঙ্গলে থাকিনি।বেড়াতে গিয়ে জঙ্গলে থাকা, নাইট সাফারির অভিজ্ঞতা থাকলেও সে অনুভুতি আর এইভাবে অপরিচিত ভয়ঙ্কর জঙ্গলে খোলা আকাশের নীচে গাছে রাত কাটানো-সম্পুর্ণ আলাদা অভিজ্ঞতা।
তখন প্রায় রাত আড়াইটে বাজে-হঠাৎ ভয়ঙ্কর ভাবে গাছে থাকা পাখীরা আর বাঁনর গুলো চেঁচামেচি হুটোপাটি শুরু করল।আমি শিকার কাহিনীতে জঙ্গলের পশুদের আচার আচরণ পড়ে জেনেছি যে কোন ভয়ঙ্কর, হিংস্র জন্তু জানোয়ার দেখলে, কাছাকাছি কোথাও এলে পাখি, বানর এরকম প্রাণীরা ভয়ে চেঁচামেচি করে,ডাকে-সকল কে সতর্ক করে দেয়।এদিকটায় বাঘ,সিংহ আছে কিনা আমার জানা নেই, তবে স্থানীয় লোকেদের মুখে শোনাযায় যে বাঘ, সিংহ এদিকটায় নেই বললেই চলে তবে ভয়ংকর 'বুগুডুম্পা'র সন্ধান মেলে, সেপ্রাণী আরো মারাত্মক খুউব ই ভয়ঙ্কর। বুগুডুম্পা কি? জানতে চাইলাম-এ সাক্ষাৎ শয়তান-প্রাণী না উদ্ভিদ কেউ জানেনা-স্থানীয় আদিবাসীরা বলে এ সাক্ষাৎ শয়তান বহুরুপী,কখন ও গাছ, কখন ও গাছের ডাল ,কখন মাছ, ডাঙ্গায় কোন বন বিড়ালের মতন জন্তু, কখন ও বুকে হাঁটা গোসাপের মতন, কখন ও নিছক নিস্প্রাণ পাথরের ঢিবির মতন নানা রুপ আকৃতি ধারন করে। আসলে সে সব রুপ ধরতেই সক্ষম। চারপাশের সাথে গিরগিটি,বহুরুপীর মতন রঙ বদলায়।প্রচণ্ড হিংস্র। বড়বড় জন্তু যেমন বুনো মোষ,সিংহ,হাতির মতন বড়বড় প্রাণীর দেহ থেকে খামচে,কামড়ে মাংস খেয়ে নেয়।ঐ প্রাণীরাও বুগুডূম্পার আক্রমণে মারা যায়। তাই সবাই ভীষণ ভয় পায় আতঙ্কে থাকে। এই প্রাণীর দেখা পাওয়া দুষ্কর । দিনের বেলা এরা কখনো আক্রমণ করেনা, ঘুমায়। এক জায়গায় হয়ত পাথরের সাথে মিশে বা গাছের ঝোঁপে কোন গাছ যেমন ফণী মনসা রুপ ধরে,চেনা যায়না ফলে কেউ দেখেছে এদের কাছ থেকে কিম্বা ছবি তুলেছে বলে জানা যায়নি। তবে অনেক শিকারি,অনেক আদিবাসী এদের অস্তিত্ব বুঝতে পেরেছে-দুর থেকে দেখেছে কিন্তু কিছুই করতে পারিনি। মনে হয় এই প্রাণী অনান্য প্রাণীর অস্তিত্ব দূর থেকে বুঝতে পারে।আরো বুঝতে পারে প্রাণীটি কি প্রকৃতির, বিপদ বুঝলে লুকিয়ে পড়ে,নিজেকে ক্যামোফ্লেজ করে,নইলে আক্রমণ করে।ছোট ছোট পোকামাকড় ,জন্তু জানোয়ার ধরে খায় তার কোনো অবশেষ পড়ে থাকেনা।এরা গাছ পালার আড়ালে,পাহাড়ের গর্ত্তে লুকিয়ে থাকে।বহু তন্ন তন্ন করে খুঁজেও অনুসন্ধান করেও হদিশ পাওয়া যায়নি। এজন্য বুগুডুম্পা একটা রুপ কথার কাল্পনিক প্রাণী, অলীক বস্তু বলেই সবার বিশ্বাস।
পাখীর আর বাঁদরের কিচিমিচি ,হৈ চৈতে সতর্ক হয়ে চারপাশে তন্ন তন্ন করে খুঁটিয়ে দেখতে লাগলাম। আমাদের দুজনের কাছেই' নাইট ভিশন ' দুরবীন আছে রাত্রেও স্পষ্ট দেখতে পাওয়া যায়,এগুলো ইনফ্রা রেড আলোয় দেখা যায়,সেনা বাহিনীর কাছে থাকে। আমরা দুটো বন্ধুর কাছ থেকে জোগার করে নিয়ে এসেছি।ফিরে গিয়ে ফেরৎ দিয়ে দেব।
হঠাৎ দেখি জঙ্গলের এক প্রান্ত যে দিকটা অপেক্ষাকৃত ফাঁকা পাহাড়ের ঢাল এসে সমতলে মিশেছে,ছোট ছোট গাছের ঝোঁপ, বড়বড় পাথরের খণ্ড ইতঃস্তত ছড়িয়ে আছে সেখানে। বোধহয় দিনটাছিলো পূর্ণিমা-চাঁদের আলো এসে ঐ ফাঁকা জায়গাটাতে পড়েছে, দিনের মতনই স্পষ্ট দেখাযাচ্ছে চারপাশ।দেখলাম একটা ডিমের মতন পাথরের খণ্ড গড়িয় গড়িয়ে জঙ্গলেরই একপাশে আসছে। পাথরের খণ্ডটা বেশ মাঝারি উচ্চতার চার ফ্যটের মতন লম্বা আর ফুট তিনেক চওড়া।কোন জন্তু হবে হাত পা মুখ কিছুই নেই। খণ্ডটার উপর দিকে দুটো বড়বড় চাকার মতন গোল লাল আলো জ্বলছে। তীব্র আলো নয়-অনেকটা নিভন্ত কয়লার মতন। বুঝলাম এটা নিশ্চয় কোন জন্তুই হবে।চোখের ঐ লাল আভা-এর একটু নীচে একটা গর্ত মতন যেখান দিয়ে মাঝে মাঝে একটা সাপের জিভের মতন সরু লিক লিকে চেরা জিভ বেরুচ্ছে। লক লক চারপাশে ঘুরে আবার সাপের জিভের মতন ই ঢুকে যাচ্ছে।ওটাই বোধ হয় শ্বাস প্রশ্বাস নেবার জন্য,অথবা খাদ্যের অনুসন্ধানের জন্য।ঐ প্রাণীটি বা বস্তুটি মাটি দিয়ে গড়িয়ে আসার মতন আসছে ধীরে ধীরে।
খুউব মনযোগ সহকারে লক্ষ্য করছিলাম- ভয়ে আতঙ্কে নিঃশ্চুপ। আমাদের থেকে হাত পঞ্চাশেক দুরে যখন তখন দেখি ঐ জন্তুটার ভাল্লুকের মতন সারা দেহ ঘন কালো লোমে ঢাকা, পায়ের ওখানে গোল বলের মতন খেলনা গাড়ির চাকা লাগানো।ঐ বলের মতন অংশটা ঘুরছে আর জন্তুটা চলা ফেরা করছে। হঠাৎ জঙ্গলের ভেতর থেকে মর মর করে শুকনো পাতার ওপর দিয়ে কোন জন্তু বা কিছুর হেঁটে আসার শব্দ শুনতে পেলাম-আর অবাক কাণ্ড ঐ গোলাকার জন্তুটা মুহুর্তে উধাও হয়ে গেলো,ঐ জায়গায় একটা ফুট চারেকের কাঁটা ফণী মনসার মতন গাছ দাঁড়িয়ে। আমরা অবাক বিস্ময়ে হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে আছি, এমন সময় দেখি জঙ্গলের মধ্যে থেকে একটা বুনো শুয়োরের মতন প্রাণী তবে ঠিক কি প্রাণী বুঝতে পারলামনা -ধারালো দুটো দাঁট আছে, বুঝলাম খুউব ই হিংস্র প্রকৃতির প্রাণী ক্ষিপ্র গতিতে জঙ্গল থেকে বেড়িয়ে ঐ মনসা গাছটার কাছে আসতেই মনসা গাছটা সপাটে প্রাণীটাকে জাপ্টে ধরলো।তারপর দেখি কোথায় মনসা গাছ?প্রাণীটাকে ঢেকে রেখেছে একটা গাঢ় খয়েরী রং এর চাদর।তারপর? কিছুক্ষণ বাদে দেখি ওটা আবার পাথরের খণ্ডের মতন হয়ে গেছে- আর গড়িয়ে গড়িয়ে পাহাড়ের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। আমি হিতা হিত ভুলে গিয়ে রিভাল্ভারটা নিয়ে মুহুর্তে গুলি চালিয়ে দিলাম পরপর ।টং করে একটা ধাতব শব্দ শুনলাম, তারপর দেখি ঐ পাথরের খণ্ড মুহুর্তে প্রকাণ্ড পাখী প্রাগৈতিহাসিক যুগের টেরোডাকটাইলের (বইতে চবি দেখেছি )মত হয়ে সোঁ সোঁ করে ডানা ঝাপটিয়ে উড়ে চলে গেলো পাহাড়ের দিকে।মুহুর্তে অদৃশ্য হয়ে গেলো।
লোকশ্রুতি সত্যই বুগুডুম্পা আছে-আর তার অদ্ভুত ভৌতিক আচরণ । আমার কথা সভ্য জগতে কেউ বিশ্বাস করবেনা, করেওনি -তাই নানা উপহাস আর বিদ্রুপ শুনেছি-কেউ কেউ বলেছে আমি নেশাগ্রস্থ ছিলাম,কেউ বলেছে আতঙ্কে কল্পনায় মরিচিকা দেখেছি। আমার সাথী আর আমি দুজনেই দেখেছি।
No comments:
Post a Comment