আমি বেশ কিছু জনের একান্তভাবে অনুরোধে ১৯৭৪থেকে১৯৭৬ সালে জঙ্গল মহলে থাকা কালীন যে পরিবেশ, মানুষ জন কে কাছ থেকে দেখার মেলা মেশা করার সুবাধে তাদের মানসিকতা ও জীবন যাত্রার সাথে পরিচয় ঘটেছিলো তার একটা চিত্র তুলে ধরার চেষ্টা কোরলাম, সাথে রোমাঞ্চকর ঘটনা, অভিজ্ঞতা,ডাকাতের মহানুভবতা আমারআঁকা ছবির সাথে কয়েক টা কিস্তিতে লিখলাম। ফিরে দেখা(১৯৭৪-১৯৭৬) ।। আশাকরি এতে বোঝাযাবে, আজ জঙ্গল মহলে কেনো বারুদের গন্ধ?
বাসের ছবি
(১) ফিরে দেখা (১৯৭৪-১৯৭৬)
১৯৭৪ সালে এমন একদিনে হাতে নিয়ে নুতন চাকরির নিয়োগপত্র রওনা হয়ে ছিলাম মেদিনীপুর জেলার উদ্দেশে । পথে অনেক বাধা বিপত্তি কাটিয়ে ঝাড়্গ্রামে পৌঁছলাম বিকালে ওখানে জানলাম, আমাকে যেতে হবে বীনপুর থানার এক প্রত্যন্ত গ্রামে সেখানে এমন মানুষ আছেন যে ট্রেণ দেখেনি, একটু ইলেক্ট্রিকের আলো দেখতে হলে ৯/১০ কিলোমিটার হেঁটে যেতে হবে নদী পেরিয়ে । চারপাশে নদী ঘেরা দীপের মতন জায়গা, গ্রামের নাম নেপুরা । সকাল ৭টা য় ঝাড়গ্রাম স্টেশন থেকে একটা দেশলাই বাক্সের মত লড়ঝড়ে বাস ছাড়ে , এই বাসে মানুষ জনের সাথে,মাল পত্র,ঝুড়ি,বস্তা,হাঁস,মুরগী,ছাগল নিয়েই যাত্রীরাবাসের ভিতরে, ছাদে, ওঠে পথে যেতে যেতে নানা দোকানের মাল পত্র নামাতে তুলতে হয় ,কারণ এটাই এক মাত্র বাস যে বাস টি বীনপুর থেকে বেঁকে বোলডার মোরাম ফেলা রাস্তায় আরো ৭-৮কিলোমিটার প্থ , সেই হাড়দা অবধি যায় , এটাই আবার স কাল ১০টায় হাড়দা ছেড়ে ঝাড়্গ্রাম ফিরে আসে । বিকাল ৩টায় ঝাড়্গ্রাম থেকে আবার একবার ছেড়ে হাড়দা যায় ওখান থেকে ছাড়ে সন্ধ্যা ৬টায় ।এই বাসের ও কোন নিশ্চয়তা নেই , মাঝে মাঝেই বন্ধ থাকে। ক্রমশ -২
নেপুরার রাস্তা চু য়ার আর কলসি করে জল আনার ছবি
(২) ফিরে দেখা (১৯৭৪-১৯৭৬)
আগের লেখায় আমি ঝাড়্গ্রাম থেকে লড়ঝড়ে বাসে মাল পত্র গরু ছাগলেরসাথে হাড়দা আসা,এবার হাড়দা থেকে এঁটেল মাটির উঁচু নিচু প থ , বর্ষায় দুর্গম এঁটেল মাটির কাদা, পা হড়কে যায়, কাদা কামড়ে ধরে এক একটা পা ২০-৩০ কেজি ওজন হয়ে যায় । শীতে গ্রীষ্মে তেমন ধুলো ময়। পথ ভীষণ এবড়ো খেবড়ো, এই পথে প্রায় ৪/৫ কিলো মিটারর যেতে হবে ,জায়গাটার নাম ডাংগড়পাড়া ,তারপর পড়বে তারাফেণী নদী ।এইনদীটা খুউব চওড়া নয় ,বর্ষা ছাড়া অন্য সময় হেঁটে পেরুতে হয় । জল থাকে হাঁটু অবধি,কখনও বা বুক অবধি ।গরু, মোষ, মানুষ জন,গরুর গাড়ি,সব কিছুকেই এভাবে পেরুতে হয় । কবি গুরুর আমাদের ছোট নদী, চোখের সামনে দেখার সৌভাগ্য হোলো আমার। নদী পেরুনোর পর আবার হাঁটা পথ,সেই ভীষণ এবড়ো খেবড়ো, উঁচু নীচু পথ ,ধুলো মাটিতে ভরা,দুরত্ব কমাতে হলে ধান ক্ষেতের আলপথ ধরে যাওয়া যায়,কিন্তু ও পথে ভীষণ সাপের ভয় । এই পথেও ৪ -৫ কিলো মিটার গেলে পর নেপুরা গ্রাম ।
প্রথম যেবার আমি গেছিলাম মনে তারাফেণী নদী পেরুনোর পর খানিকটা পথ যাওয়ার পর ছোট্ট একটা প রিচ্ছন্ন গ্রাম নাম সম্ভবত পাপদপুর ,ঐ গ্রামে আদিবাসিদের সুন্দর খড়েছাওয়া মাটির বাড়ি চারপাশ নিকানো দেওয়ালে সুন্দর আলপনা আঁকা দেখলাম। আমি যে গ্রামে যাব সেটা কোন পথে কতো দূর জান তে চাওয়ায় ঐ গ্রামের লোকজন আমাকে হাতের আঙুল তুলে দূরে ফাঁকা মাঠেরদিকে দেখিয়ে বোললো" ওই যে হুথা লিক লিক কোরছে ওই খানে আমি যাব কি ভাবে? এর উত্তরে জানালো মাঠের গুড়ায় গুড়ায় লিকে লিকে চলে যেতে হবে " আমি প্রথমে এই ভাষার কিছুই বুঝিনি পরে আরো আনেক কে জিজ্ঞাসা করে জেনেছিলাম , মাঠের গুড়ায় মানে চাষের মাঠের আল ধরে আর লিকে লিকে মানে গরুর গাড়ি চ ললে মাঠে যে গাড়ির চাকার দাগ পড়ে তাকে লিক বলে । লিক লিক করছে মানে দেখাযাচ্ছে । গ্রামে মাইল দুরত্ব মানে অনেকে চুটকি হিসাবে বলেন, ডাল ভাঙা দুরত্ব মানে একটা গাছের ডাল ভেঙে হাতে নিয়ে হাঁট তে শুরু কোরলে ঐ ডালটা যখন শুকাবে এক মাইল তখন হবে।গ্রামের পাশ দিয়েই বয়ে চলেছে চওড়া কংসাবতী চলতি নাম কাঁসাই নদী ।সারা বছর হাঁটু জল থাকে কিন্তু বর্ষার সময় ভীষণাকার ধারণ করে, খুউব স্রোত তখন পেরুনো যায়না ।গ্রামে থাকার মধ্যে একটা ডাকঘর,বিকালে রানার চিঠি নিয়ে আসে ওপাড়ে লাল গড় থেকে ।মেদিনীপুর থেকে লাল গড় টানা বাস যাতায়াত করে, অপেক্ষাক্রিত ভালো রাস্তা । নেপুরা থেকে কাঁসাই নদী পেড়িয়ে লাল গড় ৫-৬ কিলোমিটারের বেশি পথ। নেপুরা গ্রামে কোনো হাট বাজার নেই,কাঁসাই পেড়িয়ে ওপাড়ে মাজুরিয়া বলে একটা জায়গা আছে, সেখানে সপ্তাহে দু দিন হাট বসে । ওখান থেকেই সবার বাজার হাট করা হয়। গ্রামের লোকেদের নিজেদের ই সবার থাকার খাওয়ার ঘর দুয়ার নেই, পয়ঃপ্রণালীর ব্যবস্থানেই, কাঁসাই নদীর পাড়েই বা ঝোঁপ ঝাড়ে সবার শৌচাগার,প্রাত ক্রিত্য সারার ব্যবস্থা ।পানীয় জলের কোন ব্যবস্থা নেই বড় দুটি ইঁদারা আছে । নদীরপাড়ে বালী খুঁড়ে গত্ত বানানো হয়, সেই গত্তে নদীর জল চুঁইয়ে চুঁইয়ে একটু একটু করে জমা হয়, একে গ্রামের লোক ছুঁয়ার জল বলে । এটাই এক মাত্র খাবার জল ।কলসী ভরে আনতে হয় ।গ্রামের সবাই এই ভাবেই খাবার জল আনে । ক্রমশ -৩
(৩) নেপুরা গ্রামের ছবি ,
ফিরে দেখা (১৯৭৪-১৯৭৬)
ঝাড়্গ্রাম থেকে নেপুরা পৌঁছানোর বর্ণণা করেছি, বীনপুর থানার অন্তর্গত এই প্রত্যন্তগ্রাম, আমিকখনো একা কোথাও থাকিনি, বাড়ির সকলে তাই চিন্তিত,এই গ্রামে আমি কিকরে থাকব? আমি প্রায় ই অসুস্থ হয়েপড়ি, তাই বাড়ির কেউনা কেউ আমার সাথে থাকে ।আমি এই গ্রামে আসার কিছুদিনের মধ্যে বিয়ে করে বৌ সমেত এই গ্রামে থাকতে শুরু করি।আমার মতন আমার স্ত্রীও বরাবর শহরে থেকে বড় হয়েছে,এম্ন গ্রাম,দুরগম পথ,এই আনাড়ম্বর জীবন,এই কঠিন বাস্তব একদম আজানাহলেও ,এর সঙ্গে বেশ খাপ খাইয়ে নিয়ে থাকতে শুরু করলাম। গ্রামের জীবন জাত্রা তাদের দৈনন্দিন জীবনের সুখ দুঃখ চাওয়া পাওয়া,প্রতিদিননের বেঁচে থাকার লড়াইকে একদম কাছ থে কে দেখতে শুরু করলাম। একটা আলাদা মাটির পাঁচিল দিয়ে ঘেরা বাড়িতে একটা ঘর,ভিত্রে উঠান,রান্নাঘর ভাড়ানিয়ে থাকতাম, আমার বাড়িতে প্রায়ই বাড়ির আত্মীয় স্বজন আসতো।তাই ঘরের লাগোয়া জায়গায় আমি দরমা ঘিরে অস্থায়ী কুয়া পায়খানা বানিয়ে নিয়ে ছিলাম,বাড়ির লোকেরা দেখে বেশ অবাক হয়ে তারিফ কোরতো । মাটির ঘরে খড়ের চাল,দড়ির খাটিয়া,জংগলের কুড়ানো জালানী, কাঠে জালানোর উনুনে ফুক নলে ফু দিয়ে স্ত্রী রান্না করে ,কুয়ো থেকে জল তুলে স্নান করা মাঝে মাঝে কাঁসাই নদীতে গিয়ে স্নানকরা ,সবই ভালোলাগত,কিন্তু সন্ধ্যারপর চারদিক নিঃস্তব্দনিঝুম অন্ধকার যখন নেমেআসতো,চারপাশেঝিঁ ঝিঁ ডাকতো,জোনাকি জ্বলতো, তখন জানি কেমন একটা অজানা ভয় প্রথম প্রথম পেয়ে বসতো, ভাবতাম রাত বিরাতে যদি কোন সমস্যা হয়? গ্রামে কোন ডাক্তার ঔষধপত্র কিছুই নেই,পাওয়া যবেনা কারন গ্রামে কোন পাশ করা ডাক্তারনেই, সাস্থ্য কেন্দ্র হাঁস্পাতাল বলতে নদী পেড়িয়ে হয় বিনপুর নয়ত সেই বাঁকুড়া্র সারেংগা ,বহু দুরত্ব কোনটাই ১২-১৪ কিলোমিটারের কম পথ নয়। ক্রমশ -৪
মাজুরিয়ার হাটের ছবি
(৪) ফিরে দেখা (১৯৭৪-১৯৭৬)
মেদিনীপুর জেলার ঝাড়্গ্রাম মহকুমার বীনপুর থানার অন্তর্গত এই প্রত্যন্ত গ্রামে আমি সপরিবারে থাকতাম তখন ঐ গ্রাম ই আমার একান্ত নিজের জগত হয়ে উঠেছিলো গ্রামের মানুষ জনেদের সাথে একটা আন্তরিক ঘনিষ্ট বন্ধুতব তৈরী হয়ে গেছিলো, তাই গ্রামের অনেক ছেলে মেয়েই আমার বাসাতে অভিগ্নতার কথা শোনাতেন।আমরা অবাক হয়ে শুনতাম,মাঝে মাঝে অবিশাস্য বলেমনে হোত। আমারই সমবয়সী ঐ গ্রামের কিছু যুবক আমার খুউব বন্ধু হয়ে গেছিলো, তারা আমাকে প্রায়ই বলত রাতে কাঁসাইনদীর পাড়ে"উল্কামুখী" শিয়াল দেখা যায় ।আমাকে অবাক হতে দেখে ওরা আমাকে বলেছিলো ঐ শিয়াল গুলো যখন ডাকে ওদের মুখের ভিতর লাল আগুন জ্বলে ।রাতে যখন ওরা বের হয় ,শিয়াল ডাকে তখন নদীর পাড়ে গেলে দেখা যাবে ।আমাকে এক দিন নিয়ে যাবে দেখাতে আমার দেখা হয়ে ওঠেনি তবে বুঝেছিলামঅন্ধকারে এমন অনেক হ্রিংস্র জন্তুর মুখের ভিতর লুসিফেরণ থাকায় বিড়ালের চোখের মতন অন্ধকারে জ্বলজ্বল করে ,ভিত রের মুখ গহ্বর লাল তখন ম্নে হয় আগুন জ্বলছে অগ্নিকুন্ড । গ্রামের অধিকাংশ লোকের সারল্য আমাদের মুগদ্ধ করেছে , তাদের দারিদ্র ,কষ্ট,অসহায়তা তাদের মনের সরলতাকে গ্রাস করতে পারিনি, কিন্তু এই গ্রামেই দেখেছি আরেক শ্রেনীর লোকজন আছেন যাদের মনে নানা রকম ছল চাতুরী,জীবনে নানা রকম অভিসন্ধি ,কায্যকলাপ আমারজ্ঞানতঃদেখাজানাঘটনার থেকেও বিচিত্রভয়ঙ্কর।সামান্যঅর্থ সমপত্তির জন্য এরা করতে পারেনা এমন কোন ও কাজ নেই ।কিছু কিছু পরিবারের মানুষ জনের কাছেঅর্থ,প্রতিপত্তিআছেতাদেরভয়ে মান্য করেসকলেচলে,যাদেরঅর্থবলনেইক্ষমতা নেই তারা উপেক্ষিত,এই বৈষম্য আমাকে মনে বেশ নাড়া দেয় কষ্টহয় । আমার মামা বড় চিত্র শিল্পী তাঁর রঙতুলিতে এখানকার প্রকৃতি,গ্রামের মানুষ জনের নিষ্পাপ সরল মুখায়ব,তাদের নানা আচারআচরণ ক্যানভাসে মুর্ত্ত হয়ে উঠেছে। মামা নদী পেড়িয়ে হাটে গেছেন, সেখানে আদিবাসী বাচ্চা,বয়ষ্ক,মাঝ বয়সি সবার হাটে নানা ভঙ্গিমাতে,শততালিরছাতা মাথায় নানা অবস্থায়,জিনিস কেনা,হাঁড়িয়া খাওয়ার জন্য লাইন দিয়ে অপেক্ষা,হাঁড়িয়া খাওয়ার জন্য আকুল উতসাহ ,খাওয়ার তৃপ্তি,সব কিছুই শিল্পীর তুলিতে প্রাণবন্ত হয়ে উঠেছে। দরিদ্র নেই কিন্তু মুখে হাসি লেগে আছে,ভাবা যায়? হাড়িয়ার নেশায় বাচ্চা থেকে বুড়ো সবাই বুঁদ হয়ে থাকে।এ ছাড়া উপায় কি? নইলে ক্ষিদেরজ্বালা চাগার দিয়ে উঠবে।গ্রামের মুদির দোকানে ধার কোরলে শোধ করবে কি করে? ধার তারাই পায় যাদের শোধ করার ক্ষমতা সঙ্গতি আছে। যুবকদের কাজ বলতে চাষের কাজ, দুচার জন প্রাইমারি স্কুলে শিক্ষকতা করেন,বেশী ভাগই বেকার ।গ্রামে অবস্থাসম্পন্ন এমনদু চার ঘরের ছেলেরা বাইরে কোলকাতা,টাটা,জামসেদপুরে লেখাপড়া করে সেখানে কেউ কেউ প্রতিষ্ঠিত।
ক্রমশ -৫
গরুর গারি চেপে যাওয়া আর লাঠি হাতে ডাকাত
(৫) ফিরে দেখা (১৯৭৪-১৯৭৬)
এই নেপুরা গ্রামে বেশীর ভাগ মানুষ ই দরিদ্র ,চাষ বাসের কাজ ছাড়া কাজের কোনো সুযোগ নেই মেদিনীপুরের এই প্রত্যন্ত গ্রামে দুচার জন অন্যত্র প্রতিষ্ঠিত,অধিকাংশের অবস্থা খারাপ, কোনমতে দিন চলে,আমোদ প্রমোদ বলতে কিছুই এই গ্রামে নেই । আগে গ্রামে পুজা পার্বণেবেশ ধুমধাম করে উতসব, মজা হোতো, গ্রামের লোকেরা নিজেরাই যাত্রা পালা কোরতো এখন সেই রেওয়াজ উঠে গেছে।দূর গ্রামে যেখানে বিত্তবান লোকজন আছেন,যোগাযোগ ব্যাবস্থা ভাল ক্লাব,বসতি আছে সেখানে শীতের দিনে মাঝে মাঝ কোলকাতার নামকরা নট্টকোম্পানীর যাত্রাপালা হয় টিকিট করে। গ্রামের কিছু উতসাহী মানুষজন গরুরগাড়ি করে ন ইলে হেঁটে নদী পেরিয়ে সেই যাত্রা দেখতে যায়। আমিও সস্ত্রীক দুবার এরকম যাত্রাপালা দেখতে গেছি গরুরগাড়ি চেপে,একবার বীনপুর অন্যবার রামগড়। রাতে গরুরগাড়ি করে গ্রামের ঐ পথে যাওয়া ভয়ের কারন ঐ অঞ্চলে ডাকাতি ছিন্তাইএর ঘটনা ঘটে। একটা গল্প শুনেছিলাম ঐ তারাফেণী নদীর পাড়ে একটা গ্রাম আছে,সেই গ্রামে একজন নামকরা ডাকাত থাকতেন যার নাম শুনলে সকলেই ভয়ে শিউরে উঠত ।বীনপুর থেকে সন্ধ্যার পর কেউ ঐ হাড়দা পেরিয়ে এদিকের কোন গ্রামে আসতোনা ঐ ডাকাতের ভয়ে ।একবার একজন দরিদ্র মানুষ তার মেয়ের বিয়ে দেবার টাকা যোগারের জন্য বীনপুরের গরুর হাটে তার গরু বিক্রি করে সেই টাকা নিয়ে ফিরছিলেন। এবার বীনপুর থেকে হাড়দা পৌঁছতেই সন্ধ্যা ঘনিয়ে এসেছে এরপর অন্ধকারে ঐ রাস্তায় তারাফেণী নদী পেরিয়ে যেতে হবে অনেকটা পথ । কি কোরে যাবেন ঐ পথে? এমনসময় ওই ভদ্রলোক দেখেন একজন গাট্টাগোট্টা লোক হাতে তার লম্বা তেল মাখানো লাঠি গাঁটে গাঁটে পিতলের আংটা পড়ানো রয়েছে। ঐ লোকটা এগিয়ে এসে জিজ্ঞাসা ক্রলেন, যাবেন কোথায় ? ভদ্রলোক তার গাঁয়ের নাম বললেন, তখন ঐ লাঠিধারি লোকটি বললেন চলুন আয়মি ঐ গাঁয়ের পাশের গাঁ তে থাকি একসাথে গল্প করতে করতেএতোটা পথ যাওয়া যাবে ।ঐ দরিদ্র লোকটি তখন লাঠি ধারি লোকটিকে বললেন , না না আমার পক্ষে যাওয়া রাতে এই পথে যাওয়া সম্ভব নয়, সাথে কিছু টাকা আছে গরুবিক্রী করে পাওয়া, মেয়ের বিয়ের জন্য ,এটা যদি পথে ঐ ডাকাত কেড়ে নে্য আমরা সপরিবারে মারা যাবো।এই কথা শুনে লাঠিধারি লোকটি বললেন ,আমিসঙ্গে থাকলে ডাকাত কেন? স্বয়ং যম কাছে আসতে ডরাবে।এই লাঠি যতক্ষণ আমার হাথে থাকবে ততক্ষণ কোন হ্রিংস্র জন্তুও আমার কাছে ঘেঁষবেনা, তুমি নিশ্চিন্তে চলো বরং এখানে থাকলে যে ঐ ভয়ঙ্কর ধীরেন বাগাল (নাম পরিবর্ত্তিত )এখানে এসে তোমার সব কেড়ে নিবেনা তার নিশ্চয়তা কে দিবে ? লোকটা ভেবে দেখলো কথাটা সত্যি,এখানেই বা কে বাঁচাবে? সঙ্গে যেতে রাজী হয়ে পথচলতে শুরু করলো ।পথেদুজনার অনেক কথা বার্তা হোলো ঘ ন্টা দুয়েক বাদে লোকটিকে তার বাড়িতে পৌঁছে দিয়ে লাঠি ধারি এবার নিজের বাড়ি যাবার জন্য তৈরি হয়েছেন তখন ঐ গরীব লোকটি তার মেয়ে, বৌকে ডেকে বললেন ইনি দেবদুত, ভগবান আজ এনাকে পাঠিয়েছেন আমাদের রক্ষাকোরতে নইলে আজ ই ঐ যমদুত ধীরেন বাগাল আমার সব কেড়ে নিতো । লোকটি তার মেয়ের বিয়ের দিনে লাঠিধারি কে আসার জন্য একান্ত অনুরোধ জানালো । তখন ঐ লাঠিধারি লোক টি বললেন আমি কথা দিচ্ছি তোমার মেয়ের বিয়েতে আমি আসবো, তবে ভগবান কে ধন্যবাদ জানাও যে তুমি ধীরেন বাগাল কে চেনোনা, তাকে কখনও দেখনি,কারন যদি তুমি তাকে চিনতে আজ হাড়দাতে তাকে দেখে তুমি ওখানেই ভয়েপ্রাণ হারাতে,যখন ঐ যমদুত তোমার সামনে এসেছিলো- আমি ই ঐ যমদুত ধীরেন বাগাল,আমার বাড়ি সেই তারাফেণীর পাড়ে মিদ্দাডাঙা আবার কেউ কেউ বলে বাসনবণী (নাম দুটি ই পরির্বত্তিত) এই কথাশুনেতো ওই গরীব লোকটি ভয়ে কেঁদে ধীরেন বাগাল এর দু-পা জড়িয়ে বোললে কেবলে বাবা আপনাকে যমদুত ? আপনি গ রীবের কাছে দেবদুত ভগবান ।সবাই বলে ধীরেন বাগাল সত্যি ঐ মেয়ের বিয়েতে এসে নিজে দাঁড়িয়ে থেকে বিয়ের সব খরচ করে বিয়ে দিয়ে ছিলেন। ধীরেন বাগা ল বলতেন আমরাও রক্ত মাংসের মানুষ, যখন দেখি চোখের সামনে একদল লোক ঠকাছে ,গরীবের ভাত মেরে তাদের ঠকিয়ে দুহাত ভরে টাকা লুঠছে, আর গরীব মানুষ অনাহারে,অর্ধাহারে, বিনাচিকিতসায় কুকুর শিয়ালের মতন মারা যাচ্ছে তখন পায়েররক্ত মাথায় উঠে যায়,তখন পারিনা নিজেকে সামলাতে ।
ক্রমশ -৬
(৬) ফিরে দেখা (১৯৭৪-১৯৭৬)
উপার্জনের কোনো উপায় তেমন না থাকায় ,অভাবের তাড়নায় ক্ষিদের জ্বালায় কেউ কেউ নিজেদের অসম্ভব শক্তি ,সাহস,বাহু বলকেসম্বল আশ্রয় করে ধীরেন বাগালের মতন ডাকাত বনে যায়,যার,পিছনেসমাজেরবৈষম্য,সামাজিক দুরবস্থা,অসহয়তা ,বিনোদনেরঅভাব,প্রতিদিনের বেঁচে থাকার নিদারুন জ্বালা, অনিশ্চয়তা ,আতঙ্ক মূল কারণ । দুর্ব ল মানুষের কাছ থেকে টাকাকড়িজোর করে কেড়ে নেওয়া সবল শক্তি শালীর কাছে সব চেয়ে সহজ পথ ,তাই ঐ পথের প্রবল প্রলোভন সামলানো কঠিন সহজেই ও পথে চলে যায় আক্রিস্ট হয় যুব সমাজ।, আগের ধীরেনবাগালের ঘটনাটা হয়ত বা অতিরঞ্জিতকাহিনী, কিন্তুআমি নিজে ধীরেনবাগালএরগ্রাম দেখেছি,ওখানের মানুষ জনের সাথে মিশেছি দেখেছি এরাও সন্মান দিতে জানেন।আমি একজন মাঝবয়েসী লোকের খোঁজে গেছিলাম । সত্যি বলতে কি একা যেতে একটু ভয় ভয় করছিলো তাই সাথে আমার ছায়াসঙ্গী অফিসের ই একজন কে নিয়ে গেছিলাম,সেস্থানীয় হলেওসেওআমাকেএকা পাঠাতে ভয় পাচছিলো যদি আমার কোন বিপদঘটে আসলে এরাও অহেতুক এদের ভয় পেতো । আমি ঐ গ্রামে গিয়ে ভুবন মাঝি নাম বলে খোঁজ করতে এক জন গাট্টাগোট্টা বলিষ্ঠ লোক দেখ লেই বোঝাযায় গায় অসম্ভব ক্ষমতার অধিকারি। হাতে কোদাল,আমার পরিচয় পাওয়া মাত্র সস্টাঙ্গে প্রণাম, আমি একটু বিব্রত বোধ করছিলাম, ও বলল সেকি বাবা ঠাকুর আপনি এই গরীবের ভিটেতে এইচেন আমার কত ভাগ্যি! আপনার পায়ের ধুলা পড়া কি কম ভাগ্যি ? আমি বাবাএই জমির সাথে হিংসা কোরছিলাম। বুঝলাম ভুবন মাঝি মাটি কোপানোকে জমির সাথে হিংসা বলছে। আমি মুড়ি নারকেল খাবো কিনা জিজ্ঞাসা করায় আমি বোললাম জল খাবার খেয়ে এসেছি,ডাবের জল খেলাম।খুব খুশী, আমি তখন সিগ্রেট খেতাম ও আমাকে বোলল ,বাবা আমিতো আপনের সন্মান রাখতে পারতিছিনা একটু নিশা কোরবেন সিগ্রেট আনায়ে দেব? আমাকে বলতেই আমি তক্ষুনি বলে উঠলাম নানা আমি তোমার বাড়িতে এসেছি তোমরা যা খাও,তোম্রা যে তামাক পাতা মুড়ে চটা বানিয়ে খাও আমাকে একটা দাও বাড়ি গিয়েভাত খেয়ে আরাম করে মৌজ করে খাবো (জানতাম ঐ চটা এক টান দিলে ওখানেই আমার মাথা ঘুরে যাবে সহ্য করতে পারবনা ) ভুবন যে কি খুশী হোলো লিখে বোঝাতে পারবনা। টানা ৪-৫ কিলমিটার পথ আমাদের সাথে আসে ছিলো। মুখের হাসি আজ অ চোখের সামনে ভাসে।
340
1 comment: