আজ যে কাহিনী টা লিখছি এটা শ্রদ্ধেয় সত্যজিত রায়ের
বিখ্যাত গল্প 'খগমের' ভাব ধারায়
অনুপ্রাণীত।
'যোগীর অভিশাপে' তপন কুমার বন্দ্যোপাধ্যায়
গল্পটা শুনেছিলাম আমার মায়ের দূরসম্পর্কের এক পিসতুত মামার মুখে।আজ থেকে প্রায় চল্লিশ বছর আগে। দীনু দাদু বলেই ডাকতাম ।তিনি পুর্ব বঙ্গের মানুষ ছিলেন। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ থেকে এদেশে এসেছিলেন ,বিয়ে থা করেননি , সারা পৃথিবী জুড়েবেড়ানোর নেশা।উনি পেশায় ছিলেন শিক্ষক,যা উপার্জন করতেন সব জমিয়ে বছরে ৩ বার ঘুরতে বেরুতেন।ওনার পৃথিবীর সব মহাদেশে যাওয়া হয়ে ওঠেনি। ১৯৮৬ সালে মারা যান ৮৬ বছর বয়সে। এই কাহিনী যখন কার তখন ভারত স্বাধীন হয়নি । দীনু দাদুর এক বন্ধু বন দপ্তরে সদ্য রেঞ্জার পদে উত্তীর্ণ হয়ে সাঁওতাল পরগণার একটি ফরেস্ট রেঞ্জে যোগদান করেছেন। দীনু দাদুর ভীষণ জঙ্গলের প্রতি আকর্ষণ, তাই সাথে সাথে হাজির ওই রেঞ্জার বন্ধু অমিয় সরখেল এর কাছে। দীনুদাদু যে অঞ্চলের কথা বলেছিলেন সেটা তখন ছিলো সাঁওতাল পরগণার অন্তর্গত বর্তমানে ঝাড়খণ্ডের দুমকা জেলার আগের অবিভক্ত বিহারের অংশ। দীনু দাদুর ভাষায় এখানে যাওয়ার একটা আলাদা আকর্ষণ ছিলোই কারন এটাই প্রাচীন মহাভারতের অঙ্গ রাজ্যের অংশ,ভাগলপুর ডিভিশনের অন্তর্গত,(অঙ্গ রাজ্যের রাজধানী ছিলো চম্পা ,পরবর্তী
ভাগলপুর,দূর্য্যোধন এই রাজ্যের রাজা করেন কর্ণ কে)
সাঁওতাল পরগণার এই বিস্তৃর্ণ অঞ্চল পাহাড়আর পার্বত্য ঘন জঙ্গলে ঘেরা। ইতিহাস থেকে জানাযায় এই এলাকা এশিয়ান হাতি সমৃদ্ধ ছিলো। দুমকা,গোড্ডা,পাকুড়,সাহেবগঞ্জ,দেওঘর আর জামতাড়া ঘন পাহাড়ী জঙ্গল এলাকা।
১৯৩৪ সালে দুমকার পাতাবাড়ি জঙ্গলে ১১ফুট উচ্চতার এশিয়ান এলিফ্যান্ট এর কঙ্কাল যা এখন কোলকাতার মিউজিয়ামে রাখা আছে প্রদর্শনের জন্য পাওয়া গেছে।
দুমকা জেলায় রাণীবাহাল,আসনবনী এলাকার একটা বড় রেঞ্জের দায়িত্ব, তখন ও রাস্তা ঘাট এখনকার মতন সুন্দর ছিলো না,চারপাশে ঘন জঙ্গল বনের মধ্য দিয়ে হাল্কা জীপ জাতীয় গাড়ি চলার পথ।রেঞ্জ অফিসের লাগোয়া রেঞ্জারের থাকার ব্যবস্থা, দুজন আর্দালী একজন ড্রাইভার । ঠহল দেওয়ার জন্য একটা লেফট হ্যাণ্ড ড্রাইভ উইলিস জীপ ।তখন ইলেক্ট্রিক ঐ খানে পৌঁছায়নি।বিকাল যেতেনাযেতেই ঝুপ করে রাত্রিনেমে আসে। কাছাকাছি কোনো লোকালয় বা জন বসতি নেই, দু তিন ক্রোশ মানে প্রায় ৫/৬ মাইল দূরে ছোট জন বসতি ১৫/২০ ঘরের বাস।এখান থেকে মাইল দুয়েকের মধ্যেই ঘন পাহাড়ি জঙ্গলের শুরু।বহু রকম ছোট বড় বন্য প্রাণীর বাস।এখান থেকে মাইল চারেক দূরে জঙ্গলীবাবার আস্তানা জঙ্গলের মধ্যে। ছোট্ট পাতার ছাউনী দেওয়া ঘর।সবার মুখেই এই জঙ্গলী বাবার নাম ,এনার জন্য ই এখানের জঙ্গলে এখনো প্রায় সব পশু পাখী গাছ গাছালী টিকে আছে নইলে কয়েক বছর আগে এই জংগল কাটা আর সব জীব জন্তু শিকার শুরু হয়েছিলো, ওই জঙ্গলী বাবা এসে আস্তানা করে সবাইকে বলে দিলেন এখনে গাছপালা কাটা চলবেনা, কোন জীব জন্তু, পশু পাখী মারা চলবেনা, যদি কেউ না শোনে তবে জঙ্গলী বাবা তাকে জন্তু বানিয়ে এই জঙ্গলের ই পাহারাদার বানিয়ে রেখে দেবে। এই কথা শুনে যারা জঙ্গল কেটে জন্তু মেরে নিচ্ছিলো তাদের লিডার শুভাইয়া মুণ্ডা দল বল নিয়ে সাধুবাবার আস্তানায় হাজির হয়ে সাধুবাবাকে শাসাতে লাগলো এই বলে যে সাধুর চালায় আগুন লাগিয়ে তাকেই শেষ করে দেবে,ভালো চাইলে যেন চুপচাপ থাক, কোন রকম ট্যাঁ ফো না করে এদের কাজে বাধা না দেয়, ফল তা হলে ভীষন খারাপ হবে। সবার হাতেই অস্ত্র, লাঠি, বল্লম, টাঙ্গি, তীর কাঁড়। প্রায় জনা ৫০শের দল। সাধু বাবা প্রথমে কিছুই না বলে ইশারায় চুপ করতে বললেন, তাতে কোন ফল হোলো না উল্টে হল্লা বাড়িয়ে নাচানাচি করতে শুরু করে দিলো, তাঁকে ঘিরে চারপাশে।
সাধুবাবা তখন সামনে যে হোমের আগুন জ্বলছিলো তার থেকে এক টুকরো জ্বলন্ত কাঠ নিয়ে কি মন্ত্র পড়ে কাঠে তিনবার ফু দিয়ে শুন্যে ছুঁড়ে দিলেন কাঠ টা ব্যাস মুহুর্তে আকাশ ফাটানো একশো বড় দাঁতাল হাতি হুঙ্কার দিতে দিতে এসে সব কটাকে ঘিরে ফেললো, কেউ পালাবার পথ পেলো না।এবার সাধুবাবা একজন একজন করে কাছে ডেকে বলে নাকে খত দে, কান মোল, আর বল কোন দিন এই জঙ্গল মুখো হবোনা। এক এক করে সবাই শুধু শূভাইয়া মুণ্ডা ছাড়া সাধু বাবার কথা শুনলো। শুভাইয়া সমানে সাধুকে গালাগালি দিতে লাগলো আর টাঙ্গি উঁচিয়ে মারতে গেলো। এবার হোলো কি? সাধুবাবা তার আশ্রমের সামনে থেকে এক মুঠো মাটি নিয়ে মন্ত্রপড়ে শুভাইয়ার গায়ে ছুঁড়ে দিলেন। তক্ষুনি সব হাতি মিলিয়ে গেলো পরিবর্তে দেখা গেলো সাধুবাবার পায়ের সামনে একটা বিরাট কালো চিতা যা আজ থেকে ৩০০ বছর আগেই এখান থেকে নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে শুয়ে আছে পোষা বিড়ালের মতন।
সাধু বাবা তখন সবাইকে বললেন আজ থেকে এই আমাদের জঙ্গল পাহারা দেবে সব কিছু রক্ষা করবে।
ভবিষ্যতে যে অবাধ্য হবে তাকে ই এই শাস্তি পেতে হবে। তার পর থেকে আর কেঊ এই জঙ্গলের কোন কিছু সাধুবাবার অনুমতি ছাড়া নেয় না, সাধু বাবাকে চারপাশে থেকে দুরদুর গ্রামের লোকেরা ঠাকুরের মতন ভক্তি করে। সাধুবাবা সামান্য ফল আর পোষা ছাগলের দুধ খান। প্রতি অমাবস্যায় রাত্রে পুজা হোম হয় , বহু মানুষ আসে প্রসাদনিতে এমন কি ওই চিতা টাও পুজার সময় ঐ খানে থাকে পুজা শেষে আবার জঙ্গলে চলে যায়। আরও শোনাযায় কয়েক বার অন্য জেলা,রাজ্য থেকে চোরা শিকারী এই জঙ্গলে চোরা শিকারের জন্য এসে বিভৎ স ভাবে মারা পড়েছে মুখে গায়ে বাঘের আঁচড় পাশে চিতার পায়ের ছাপ পাওয়া গেছে।এই জঙ্গলে কোনো বড় বাঘ নেই বন দপ্তর ভালোই জানে। চিতাবাঘ আছে গভীর জঙ্গলে কিন্তু এপাশে আসেনা। এখনে সাধারনত বুনো শুয়ার, খরগোশ, বনমোরগ,বন বিড়াল,হায়েনা,শিয়াল,ময়ুর এইসব প্রাণী আসে।
এই সব কাহিনী শুনে ঐ সাধুবাবার আস্তানায় যাবার খুউব ইচ্ছা হোলো। অমিয় কে বোললাম ইচ্ছার কথা,ও খানিকটা অনিচ্ছা স্বত্বেও রাজি হোলো আমার একান্ত অনুরোধে। ঠিক হোলো আগামী শনিবার বিকাল বিকাল ওই আশ্রমে যাবো ।সঙ্গে আর্দ্দালী ফাগুয়া যাবে ও সাধুবাবার খুউব ভক্ত।ও সাধুবাবার মাহাত্ব্য সব ই জানে কিন্তু কখনও যায়নি সাধুবাবাকে দেখেও নি।আজ বৃহস্পতিবার মাঝে কালকের দিন পরের দিন বিকাল ৪টায় আমি, অমিয়, ফাগুয়া আর ড্রাইভার হরিকিষাণ রওনা হলাম, জঙ্গলের পথ মাইল চারেক পথ যেতেই প্রায় এক ঘণ্টা লাগলো। পাঁচটা নাগাদ সাধুবাবার আশ্রমে পৌঁছলাম, একটু দূরে জীপটা রেখে হেঁটে হেঁটে গেলাম সাধুবাবার চালায়। ছোট তালজাতীয় পাতায় ছাওয়া চারপাশ ও ঐ পাতা দিয়ে ঘেরা। খড় পাতা তার উপর একটা মোটা কম্বলপাতা তার উপর লাল কাপড় পড়া গায়ে ওই লাল কাপড়ের খুঁট চাদরের মতন ছাড়া কিছু ই নেই তামাটে গায়ের রঙ লম্বা সু সাস্থ্য ও সুপুরুষ লম্বা চুল মাথায় ঝুটি আর দাড়ি গোঁফ,এক জনযোগী পুরুষ বসে আছেন। ওই চালার সামনে একটা লম্বা বাঁশের তৈরী বেঞ্চ জনা ছয়েক অনায়াসেই বসা যায়। ঘরের কাছে গিয়ে হিন্দিতে অমিয় সাধুবাবাকে প্রণাম জানিয়ে সবে পরিচয় দিয়ে আসার কথাটা বলতে যাবে সাধুবাবা গুরু গম্ভীর গলায় পরিস্কার বাংলায় বললেন, বাইরের বেনঞ্চটাতে আপনারা একটু বসুন আজ সন্ধ্যা হয়ে আসছে বেশী কথা বলার সময় হবেনা কারন আমার সান্ধ্য আহ্নিকের সময় হয়ে আসছে।কাল পারলে সকাল ১০টা ১১টার সময় একটু কষ্ট করে সময় নিয়ে আসবেন। কালতো সাধুবাবা অমিয়কেই রেঞ্জার সাহেব বোললো ,চিনলো কি কর্ আমাদের মধ্যে কে রেঞ্জার? সাধুবাবা তাঁর এই চালার বাইরে কোথাও যান না, আর অমিয় চাকরীতে এখানে মাস খানেক আগে এসেছে ও কোথাও ঘুরতে বের হয়নি এখনও। আর সাধুবাবার মুখে বাংলা শুনে।আমি বেশ চমকে গেছিলাম।
আমার আরো চমক বাকী ছিলো ,সাধুবাবা সোজা আমাকে বললেন কি মাষ্টার মশাই জঙ্গল বেড়াতে এসে সোজা সাধুর ডেড়ায় স্থানীয় গপ্প শুনে দেখার ইচ্ছা হোলো? আমি কোন রকমে বিহ্বলতা কাটিয়ে বললাম মানে আপনি বাঙ্গালী? আপনি আমাদের চিনলেন কি করে? তাই অবাক হচ্ছি। সাধুবাবা হেসে উত্তর দিলেন এটা আর এমনকি শক্ত ব্যপার? আমি ধ্যান জপ তপ নিয়ে থাকি জঙ্গলের বহু দুরের আওয়াজ আমার কানে আসে এখানে জীপ গাড়ি করে আসতেপারেন বন দপ্তরের লোক। কাছেই থাকেন রেঞ্জার সাহেব নতুন এসেছেন অনেকে বলা বলি করেছে শুনেছি,তাই অনার আসার সম্ভাবনা তাই বোললাম ওনার পোশাকটাও বন জঙ্গলে ঘোরার উপযুক্ত, শার্ট প্যান্ট বুট আর আপনি যে শিক্ষক তাও আপনার পোষাক হাবভাব থেকে আন্দাজ করা শক্ত নয় । এই কথা গুলো শুনলেও আমার মন এত সহজে ব্যাখ্যাটা মানতে পারছিলো না।এর পর সাধুবাবা বোললেন আমি বাঙ্গালী কিনা সব কালকে এলে জানতে পারবে।আমরা কাল আসব বলে প্রণাম জানিয়ে ফিরে এলাম রেঞ্জ অফিসে।
নানা আকাশ পাতাল চিন্তা করে রাত টা কাটলো।সকাল সকাল ব্রেক ফাস্ট সারলাম চা,ডিম ,বিস্কুট দিয়ে।দুপুরের মেনু ভাত মুরগীর ঝোল সাথে চাটনী। আজ আমি আর অমিয়, জীপ অমিয় চালিয়ে নিয়ে যাবে ছুটির দিন তাই ও ড্রাইভারকে ছুটি দিয়েছে। আমরা ১১টার আগেই আশ্রমে পৌঁছালাম।
যেতেই সাধুবাবা বেশ স্নেহ ভরে আমাদের বাইরে বেঞ্চে বসালেন। কিছু ফল আর মিস্টি খেতে দিলেন। তারপর নিজেই বললেন হ্যাঁ আমি বাঙ্গালী আমার নাম দীননাথ ঘোষাল, কোথায় বাড়ি জানাতে অক্ষম। স্কুলের পাঠ শেষ করে দীর্ঘ ২০ বছর কাটিয়েছেন হিমালয়ে ৫ বছর কামাক্ষায় ৫বছর
রাজারাপ্পায়, তারপর নিজে আস্তানা করে এই জঙ্গলে আছি। মানুষের লোভ লালসায় প্রকৃতিকে ধ্বংস করতে লেগেছে।কত গাছপালা পশু পাখী কে নিশ্চিহ্ন করে ফেলেছে।এখানেই বিখ্যাত বড় এশিয়ান এলিফ্যাণ্ট আজ বিলুপ্ত, মিঊজিয়ামে এখানের হাতির জন্তুর কঙ্কাল দেখতে যেতে হবে। আসল চিতা বিলুপ্ত হয়েছে, এখন আছে চিতা বাঘ সেটাও শিকার করে শেষ করতে বসেছে,আমি আর কত টুকু রক্ষাকরতে পারি চেষ্টা করি যত টা পারি।এই তো এতো চেষ্টা করেও পারছিনা মুন্না ওরাও কে বোঝাতে দাঁত, চামড়, হাড়ের জন্য প্রাণী গুলোকে মেরে শেষ করে দিচ্ছে।ছোট, বড় মুখের হায়েনা যা এই অঞ্চলে এখনো আছে এরা হাডলাকার(Hadlakar) বলে, চম্পাপাহাড়িতে দেখা যায়। মুন্না কথা শুনছেনা কি আর করা যাবে? ওর পরিনতি ঐ শুভাইয়ার মতো হবে ওকেই ওই জঙ্গল পাহারা দিতে হবে জঙ্গল চিতা হয়ে। এই সব শুনে আমি আগ্রহ নিয়ে জিজ্ঞাসা করলাম আচ্ছা সাধুবাবা কবে ওর বিচার হবে ?আমাদের সামনে কোরবেন? এক নিঃশ্বাসে কথা গুলো বলে ফেল্লাম।সাধুবাবা বোললেন, আগামী মঙ্গলবার অমাবস্যা ঐ দিন রাত ১২টায় ওর বিচার হবে, কেউ থাকলে আমার কোনো আপত্তি নেই। আমরা আসতে পারি ? ইচ্ছে হলে আসতে পারো তবে কত রাত্তির অবধি চলবে জানিনা।
মঙ্গল বার রাতের খাওয়া দাওয়া সেরে আমি আর অমিয় আগের দিনের মতন দুজনেই গেলাম রাত ১২টার একটু আগেই পৌঁছালাম সাধুবাবার চালায়, দেখি বিরাট হোমাগ্নি জ্বলছে কিছু গ্রামের আদিবাসী লোক জমায়েত হয়েছে মুখে চোখে তাদের আতঙ্ক।একজন লম্বা চওড়া বলিষ্ঠ লোক কে ঘিরে রয়েছে আরো কিছু লোক তাদের মধ্যে কথা কাটাকাটি তর্কা তর্কি চলছে বেশ উত্তপ্ত। সাধুবাবা ১২টা বাজতেই হাতে ইশারা করতেই ঐ লম্বা চওড়া ষণ্ডা মার্কা লোকটাকে জনা দশেক লোক টানতে টানতে হোম কুণ্ডের কাছে সাধুবাবার সামনে নিয়ে গেলো। বুঝলাম .এই মুন্না ওরাও এর ই বিচার হবে। উত্তেজনায় আমার হাতপা কাঁপছে। সাধুবাবা হিন্দিতে ভোজপুরী মেশানো যা বলছেন অমিয় আমাকে বুঝিয়ে দিচ্ছে ও স্থানীয় ভাষা বোঝে বলতেও পারে। মুন্না সাধুবাবার কোনো কথাই শুনতে চাইছেনা উলটে যাতা গালি গালাজ করছে, সাধুবাবা তখন মুন্নাকে বললেন ঐ দেখ বলে হাতের ইশারায় পাশে
অন্ধকার একটা গাছ তলার দিকে দেখালেন তাকিয়ে আমার বুকের রক্ত হিম হয়ে গেলো, দেখি অন্ধকারে গাছের নীচে একটা বড় কালো বাঘের মতন জন্তু যার চোখ দুটো আগুনের গোলার মতন অন্ধকারে জ্বলছে,আমি অমিয়কে হাত টা চেপে ধরলাম বুঝলাম ও উত্তেজনায় ভয়ে কাঁপছে।অমিয় বললো ওটা চিতা বিলুপ্ত প্রজাতির প্রাণী।এখানে চিতা বাঘ আছে কিন্তু প্রকৃত চিতা নেই।
সাধুবাবা এবার হুঙ্কার দিয়ে মুন্নাকে জিজ্ঞাসা করলেন মুন্না তুই কি চাস ? মানুষ হিসাবে বাঁচতে? নাকি তুই ঐ শুভাইয়ার মতো চিতা হয়ে জঙ্গল আগলাবি। মুন্না আরো তেলে বেগুনে জ্বলে উঠল। ও সাধুবাবাকে নোংড়া গালি দিয়ে বলে উঠলো যা পারিস কর, আমি ঐসব বুজরুকি বিশ্বাস করিনা। সাধুবাবা ওকে শেষ বারের মতন ভেবে নিতে বলাতেও ওর মত বদলালোনা, তখন রেগে সাধুবাবা বোললেন তবে তুই মরগে যা, থাক চিতা হয়ে,এই বলে এক মুঠো বালী মন্ত্র পড়ে ছুঁড়ে দিলেন মুন্নার গায়। সঙ্গে সঙ্গে মুন্না উধাও ওখানে কালো একটা চিতা, আর সেই গাছ তলার চিতাটা নেই।
এর পর সবাই চলে গেলো একে এক করে। আমি সাধুবাবাকে জিজ্ঞাসা করলাম ঐ চিতাটা শুভাইয়ার কি হোলো? সাধুবাবা বললেন আজ ও মুক্তি পেয়ে গেলো ওর জায়গায় মুন্না থাকবে আজথেকে জঙ্গলের পাহারা দার চিতা হয়ে, আবার যত দিন না কেউ নতুন করে এই ভাবে আসে তাছাড়া শুভাইয়া বদলেগেছে একদম, ও পশুপ্রেমী প্রকৃতি সচেতন দরদী হয়ে গেছে।
'যোগীর অভিশাপে' তপন কুমার বন্দ্যোপাধ্যায়
গল্পটা শুনেছিলাম আমার মায়ের দূরসম্পর্কের এক পিসতুত মামার মুখে।আজ থেকে প্রায় চল্লিশ বছর আগে। দীনু দাদু বলেই ডাকতাম ।তিনি পুর্ব বঙ্গের মানুষ ছিলেন। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ থেকে এদেশে এসেছিলেন ,বিয়ে থা করেননি , সারা পৃথিবী জুড়েবেড়ানোর নেশা।উনি পেশায় ছিলেন শিক্ষক,যা উপার্জন করতেন সব জমিয়ে বছরে ৩ বার ঘুরতে বেরুতেন।ওনার পৃথিবীর সব মহাদেশে যাওয়া হয়ে ওঠেনি। ১৯৮৬ সালে মারা যান ৮৬ বছর বয়সে। এই কাহিনী যখন কার তখন ভারত স্বাধীন হয়নি । দীনু দাদুর এক বন্ধু বন দপ্তরে সদ্য রেঞ্জার পদে উত্তীর্ণ হয়ে সাঁওতাল পরগণার একটি ফরেস্ট রেঞ্জে যোগদান করেছেন। দীনু দাদুর ভীষণ জঙ্গলের প্রতি আকর্ষণ, তাই সাথে সাথে হাজির ওই রেঞ্জার বন্ধু অমিয় সরখেল এর কাছে। দীনুদাদু যে অঞ্চলের কথা বলেছিলেন সেটা তখন ছিলো সাঁওতাল পরগণার অন্তর্গত বর্তমানে ঝাড়খণ্ডের দুমকা জেলার আগের অবিভক্ত বিহারের অংশ। দীনু দাদুর ভাষায় এখানে যাওয়ার একটা আলাদা আকর্ষণ ছিলোই কারন এটাই প্রাচীন মহাভারতের অঙ্গ রাজ্যের অংশ,ভাগলপুর ডিভিশনের অন্তর্গত,(অঙ্গ রাজ্যের রাজধানী ছিলো চম্পা ,পরবর্তী
ভাগলপুর,দূর্য্যোধন এই রাজ্যের রাজা করেন কর্ণ কে)
সাঁওতাল পরগণার এই বিস্তৃর্ণ অঞ্চল পাহাড়আর পার্বত্য ঘন জঙ্গলে ঘেরা। ইতিহাস থেকে জানাযায় এই এলাকা এশিয়ান হাতি সমৃদ্ধ ছিলো। দুমকা,গোড্ডা,পাকুড়,সাহেবগঞ্জ,দেওঘর আর জামতাড়া ঘন পাহাড়ী জঙ্গল এলাকা।
১৯৩৪ সালে দুমকার পাতাবাড়ি জঙ্গলে ১১ফুট উচ্চতার এশিয়ান এলিফ্যান্ট এর কঙ্কাল যা এখন কোলকাতার মিউজিয়ামে রাখা আছে প্রদর্শনের জন্য পাওয়া গেছে।
দুমকা জেলায় রাণীবাহাল,আসনবনী এলাকার একটা বড় রেঞ্জের দায়িত্ব, তখন ও রাস্তা ঘাট এখনকার মতন সুন্দর ছিলো না,চারপাশে ঘন জঙ্গল বনের মধ্য দিয়ে হাল্কা জীপ জাতীয় গাড়ি চলার পথ।রেঞ্জ অফিসের লাগোয়া রেঞ্জারের থাকার ব্যবস্থা, দুজন আর্দালী একজন ড্রাইভার । ঠহল দেওয়ার জন্য একটা লেফট হ্যাণ্ড ড্রাইভ উইলিস জীপ ।তখন ইলেক্ট্রিক ঐ খানে পৌঁছায়নি।বিকাল যেতেনাযেতেই ঝুপ করে রাত্রিনেমে আসে। কাছাকাছি কোনো লোকালয় বা জন বসতি নেই, দু তিন ক্রোশ মানে প্রায় ৫/৬ মাইল দূরে ছোট জন বসতি ১৫/২০ ঘরের বাস।এখান থেকে মাইল দুয়েকের মধ্যেই ঘন পাহাড়ি জঙ্গলের শুরু।বহু রকম ছোট বড় বন্য প্রাণীর বাস।এখান থেকে মাইল চারেক দূরে জঙ্গলীবাবার আস্তানা জঙ্গলের মধ্যে। ছোট্ট পাতার ছাউনী দেওয়া ঘর।সবার মুখেই এই জঙ্গলী বাবার নাম ,এনার জন্য ই এখানের জঙ্গলে এখনো প্রায় সব পশু পাখী গাছ গাছালী টিকে আছে নইলে কয়েক বছর আগে এই জংগল কাটা আর সব জীব জন্তু শিকার শুরু হয়েছিলো, ওই জঙ্গলী বাবা এসে আস্তানা করে সবাইকে বলে দিলেন এখনে গাছপালা কাটা চলবেনা, কোন জীব জন্তু, পশু পাখী মারা চলবেনা, যদি কেউ না শোনে তবে জঙ্গলী বাবা তাকে জন্তু বানিয়ে এই জঙ্গলের ই পাহারাদার বানিয়ে রেখে দেবে। এই কথা শুনে যারা জঙ্গল কেটে জন্তু মেরে নিচ্ছিলো তাদের লিডার শুভাইয়া মুণ্ডা দল বল নিয়ে সাধুবাবার আস্তানায় হাজির হয়ে সাধুবাবাকে শাসাতে লাগলো এই বলে যে সাধুর চালায় আগুন লাগিয়ে তাকেই শেষ করে দেবে,ভালো চাইলে যেন চুপচাপ থাক, কোন রকম ট্যাঁ ফো না করে এদের কাজে বাধা না দেয়, ফল তা হলে ভীষন খারাপ হবে। সবার হাতেই অস্ত্র, লাঠি, বল্লম, টাঙ্গি, তীর কাঁড়। প্রায় জনা ৫০শের দল। সাধু বাবা প্রথমে কিছুই না বলে ইশারায় চুপ করতে বললেন, তাতে কোন ফল হোলো না উল্টে হল্লা বাড়িয়ে নাচানাচি করতে শুরু করে দিলো, তাঁকে ঘিরে চারপাশে।
সাধুবাবা তখন সামনে যে হোমের আগুন জ্বলছিলো তার থেকে এক টুকরো জ্বলন্ত কাঠ নিয়ে কি মন্ত্র পড়ে কাঠে তিনবার ফু দিয়ে শুন্যে ছুঁড়ে দিলেন কাঠ টা ব্যাস মুহুর্তে আকাশ ফাটানো একশো বড় দাঁতাল হাতি হুঙ্কার দিতে দিতে এসে সব কটাকে ঘিরে ফেললো, কেউ পালাবার পথ পেলো না।এবার সাধুবাবা একজন একজন করে কাছে ডেকে বলে নাকে খত দে, কান মোল, আর বল কোন দিন এই জঙ্গল মুখো হবোনা। এক এক করে সবাই শুধু শূভাইয়া মুণ্ডা ছাড়া সাধু বাবার কথা শুনলো। শুভাইয়া সমানে সাধুকে গালাগালি দিতে লাগলো আর টাঙ্গি উঁচিয়ে মারতে গেলো। এবার হোলো কি? সাধুবাবা তার আশ্রমের সামনে থেকে এক মুঠো মাটি নিয়ে মন্ত্রপড়ে শুভাইয়ার গায়ে ছুঁড়ে দিলেন। তক্ষুনি সব হাতি মিলিয়ে গেলো পরিবর্তে দেখা গেলো সাধুবাবার পায়ের সামনে একটা বিরাট কালো চিতা যা আজ থেকে ৩০০ বছর আগেই এখান থেকে নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে শুয়ে আছে পোষা বিড়ালের মতন।
সাধু বাবা তখন সবাইকে বললেন আজ থেকে এই আমাদের জঙ্গল পাহারা দেবে সব কিছু রক্ষা করবে।
ভবিষ্যতে যে অবাধ্য হবে তাকে ই এই শাস্তি পেতে হবে। তার পর থেকে আর কেঊ এই জঙ্গলের কোন কিছু সাধুবাবার অনুমতি ছাড়া নেয় না, সাধু বাবাকে চারপাশে থেকে দুরদুর গ্রামের লোকেরা ঠাকুরের মতন ভক্তি করে। সাধুবাবা সামান্য ফল আর পোষা ছাগলের দুধ খান। প্রতি অমাবস্যায় রাত্রে পুজা হোম হয় , বহু মানুষ আসে প্রসাদনিতে এমন কি ওই চিতা টাও পুজার সময় ঐ খানে থাকে পুজা শেষে আবার জঙ্গলে চলে যায়। আরও শোনাযায় কয়েক বার অন্য জেলা,রাজ্য থেকে চোরা শিকারী এই জঙ্গলে চোরা শিকারের জন্য এসে বিভৎ স ভাবে মারা পড়েছে মুখে গায়ে বাঘের আঁচড় পাশে চিতার পায়ের ছাপ পাওয়া গেছে।এই জঙ্গলে কোনো বড় বাঘ নেই বন দপ্তর ভালোই জানে। চিতাবাঘ আছে গভীর জঙ্গলে কিন্তু এপাশে আসেনা। এখনে সাধারনত বুনো শুয়ার, খরগোশ, বনমোরগ,বন বিড়াল,হায়েনা,শিয়াল,ময়ুর এইসব প্রাণী আসে।
এই সব কাহিনী শুনে ঐ সাধুবাবার আস্তানায় যাবার খুউব ইচ্ছা হোলো। অমিয় কে বোললাম ইচ্ছার কথা,ও খানিকটা অনিচ্ছা স্বত্বেও রাজি হোলো আমার একান্ত অনুরোধে। ঠিক হোলো আগামী শনিবার বিকাল বিকাল ওই আশ্রমে যাবো ।সঙ্গে আর্দ্দালী ফাগুয়া যাবে ও সাধুবাবার খুউব ভক্ত।ও সাধুবাবার মাহাত্ব্য সব ই জানে কিন্তু কখনও যায়নি সাধুবাবাকে দেখেও নি।আজ বৃহস্পতিবার মাঝে কালকের দিন পরের দিন বিকাল ৪টায় আমি, অমিয়, ফাগুয়া আর ড্রাইভার হরিকিষাণ রওনা হলাম, জঙ্গলের পথ মাইল চারেক পথ যেতেই প্রায় এক ঘণ্টা লাগলো। পাঁচটা নাগাদ সাধুবাবার আশ্রমে পৌঁছলাম, একটু দূরে জীপটা রেখে হেঁটে হেঁটে গেলাম সাধুবাবার চালায়। ছোট তালজাতীয় পাতায় ছাওয়া চারপাশ ও ঐ পাতা দিয়ে ঘেরা। খড় পাতা তার উপর একটা মোটা কম্বলপাতা তার উপর লাল কাপড় পড়া গায়ে ওই লাল কাপড়ের খুঁট চাদরের মতন ছাড়া কিছু ই নেই তামাটে গায়ের রঙ লম্বা সু সাস্থ্য ও সুপুরুষ লম্বা চুল মাথায় ঝুটি আর দাড়ি গোঁফ,এক জনযোগী পুরুষ বসে আছেন। ওই চালার সামনে একটা লম্বা বাঁশের তৈরী বেঞ্চ জনা ছয়েক অনায়াসেই বসা যায়। ঘরের কাছে গিয়ে হিন্দিতে অমিয় সাধুবাবাকে প্রণাম জানিয়ে সবে পরিচয় দিয়ে আসার কথাটা বলতে যাবে সাধুবাবা গুরু গম্ভীর গলায় পরিস্কার বাংলায় বললেন, বাইরের বেনঞ্চটাতে আপনারা একটু বসুন আজ সন্ধ্যা হয়ে আসছে বেশী কথা বলার সময় হবেনা কারন আমার সান্ধ্য আহ্নিকের সময় হয়ে আসছে।কাল পারলে সকাল ১০টা ১১টার সময় একটু কষ্ট করে সময় নিয়ে আসবেন। কালতো সাধুবাবা অমিয়কেই রেঞ্জার সাহেব বোললো ,চিনলো কি কর্ আমাদের মধ্যে কে রেঞ্জার? সাধুবাবা তাঁর এই চালার বাইরে কোথাও যান না, আর অমিয় চাকরীতে এখানে মাস খানেক আগে এসেছে ও কোথাও ঘুরতে বের হয়নি এখনও। আর সাধুবাবার মুখে বাংলা শুনে।আমি বেশ চমকে গেছিলাম।
আমার আরো চমক বাকী ছিলো ,সাধুবাবা সোজা আমাকে বললেন কি মাষ্টার মশাই জঙ্গল বেড়াতে এসে সোজা সাধুর ডেড়ায় স্থানীয় গপ্প শুনে দেখার ইচ্ছা হোলো? আমি কোন রকমে বিহ্বলতা কাটিয়ে বললাম মানে আপনি বাঙ্গালী? আপনি আমাদের চিনলেন কি করে? তাই অবাক হচ্ছি। সাধুবাবা হেসে উত্তর দিলেন এটা আর এমনকি শক্ত ব্যপার? আমি ধ্যান জপ তপ নিয়ে থাকি জঙ্গলের বহু দুরের আওয়াজ আমার কানে আসে এখানে জীপ গাড়ি করে আসতেপারেন বন দপ্তরের লোক। কাছেই থাকেন রেঞ্জার সাহেব নতুন এসেছেন অনেকে বলা বলি করেছে শুনেছি,তাই অনার আসার সম্ভাবনা তাই বোললাম ওনার পোশাকটাও বন জঙ্গলে ঘোরার উপযুক্ত, শার্ট প্যান্ট বুট আর আপনি যে শিক্ষক তাও আপনার পোষাক হাবভাব থেকে আন্দাজ করা শক্ত নয় । এই কথা গুলো শুনলেও আমার মন এত সহজে ব্যাখ্যাটা মানতে পারছিলো না।এর পর সাধুবাবা বোললেন আমি বাঙ্গালী কিনা সব কালকে এলে জানতে পারবে।আমরা কাল আসব বলে প্রণাম জানিয়ে ফিরে এলাম রেঞ্জ অফিসে।
নানা আকাশ পাতাল চিন্তা করে রাত টা কাটলো।সকাল সকাল ব্রেক ফাস্ট সারলাম চা,ডিম ,বিস্কুট দিয়ে।দুপুরের মেনু ভাত মুরগীর ঝোল সাথে চাটনী। আজ আমি আর অমিয়, জীপ অমিয় চালিয়ে নিয়ে যাবে ছুটির দিন তাই ও ড্রাইভারকে ছুটি দিয়েছে। আমরা ১১টার আগেই আশ্রমে পৌঁছালাম।
যেতেই সাধুবাবা বেশ স্নেহ ভরে আমাদের বাইরে বেঞ্চে বসালেন। কিছু ফল আর মিস্টি খেতে দিলেন। তারপর নিজেই বললেন হ্যাঁ আমি বাঙ্গালী আমার নাম দীননাথ ঘোষাল, কোথায় বাড়ি জানাতে অক্ষম। স্কুলের পাঠ শেষ করে দীর্ঘ ২০ বছর কাটিয়েছেন হিমালয়ে ৫ বছর কামাক্ষায় ৫বছর
রাজারাপ্পায়, তারপর নিজে আস্তানা করে এই জঙ্গলে আছি। মানুষের লোভ লালসায় প্রকৃতিকে ধ্বংস করতে লেগেছে।কত গাছপালা পশু পাখী কে নিশ্চিহ্ন করে ফেলেছে।এখানেই বিখ্যাত বড় এশিয়ান এলিফ্যাণ্ট আজ বিলুপ্ত, মিঊজিয়ামে এখানের হাতির জন্তুর কঙ্কাল দেখতে যেতে হবে। আসল চিতা বিলুপ্ত হয়েছে, এখন আছে চিতা বাঘ সেটাও শিকার করে শেষ করতে বসেছে,আমি আর কত টুকু রক্ষাকরতে পারি চেষ্টা করি যত টা পারি।এই তো এতো চেষ্টা করেও পারছিনা মুন্না ওরাও কে বোঝাতে দাঁত, চামড়, হাড়ের জন্য প্রাণী গুলোকে মেরে শেষ করে দিচ্ছে।ছোট, বড় মুখের হায়েনা যা এই অঞ্চলে এখনো আছে এরা হাডলাকার(Hadlakar) বলে, চম্পাপাহাড়িতে দেখা যায়। মুন্না কথা শুনছেনা কি আর করা যাবে? ওর পরিনতি ঐ শুভাইয়ার মতো হবে ওকেই ওই জঙ্গল পাহারা দিতে হবে জঙ্গল চিতা হয়ে। এই সব শুনে আমি আগ্রহ নিয়ে জিজ্ঞাসা করলাম আচ্ছা সাধুবাবা কবে ওর বিচার হবে ?আমাদের সামনে কোরবেন? এক নিঃশ্বাসে কথা গুলো বলে ফেল্লাম।সাধুবাবা বোললেন, আগামী মঙ্গলবার অমাবস্যা ঐ দিন রাত ১২টায় ওর বিচার হবে, কেউ থাকলে আমার কোনো আপত্তি নেই। আমরা আসতে পারি ? ইচ্ছে হলে আসতে পারো তবে কত রাত্তির অবধি চলবে জানিনা।
মঙ্গল বার রাতের খাওয়া দাওয়া সেরে আমি আর অমিয় আগের দিনের মতন দুজনেই গেলাম রাত ১২টার একটু আগেই পৌঁছালাম সাধুবাবার চালায়, দেখি বিরাট হোমাগ্নি জ্বলছে কিছু গ্রামের আদিবাসী লোক জমায়েত হয়েছে মুখে চোখে তাদের আতঙ্ক।একজন লম্বা চওড়া বলিষ্ঠ লোক কে ঘিরে রয়েছে আরো কিছু লোক তাদের মধ্যে কথা কাটাকাটি তর্কা তর্কি চলছে বেশ উত্তপ্ত। সাধুবাবা ১২টা বাজতেই হাতে ইশারা করতেই ঐ লম্বা চওড়া ষণ্ডা মার্কা লোকটাকে জনা দশেক লোক টানতে টানতে হোম কুণ্ডের কাছে সাধুবাবার সামনে নিয়ে গেলো। বুঝলাম .এই মুন্না ওরাও এর ই বিচার হবে। উত্তেজনায় আমার হাতপা কাঁপছে। সাধুবাবা হিন্দিতে ভোজপুরী মেশানো যা বলছেন অমিয় আমাকে বুঝিয়ে দিচ্ছে ও স্থানীয় ভাষা বোঝে বলতেও পারে। মুন্না সাধুবাবার কোনো কথাই শুনতে চাইছেনা উলটে যাতা গালি গালাজ করছে, সাধুবাবা তখন মুন্নাকে বললেন ঐ দেখ বলে হাতের ইশারায় পাশে
অন্ধকার একটা গাছ তলার দিকে দেখালেন তাকিয়ে আমার বুকের রক্ত হিম হয়ে গেলো, দেখি অন্ধকারে গাছের নীচে একটা বড় কালো বাঘের মতন জন্তু যার চোখ দুটো আগুনের গোলার মতন অন্ধকারে জ্বলছে,আমি অমিয়কে হাত টা চেপে ধরলাম বুঝলাম ও উত্তেজনায় ভয়ে কাঁপছে।অমিয় বললো ওটা চিতা বিলুপ্ত প্রজাতির প্রাণী।এখানে চিতা বাঘ আছে কিন্তু প্রকৃত চিতা নেই।
সাধুবাবা এবার হুঙ্কার দিয়ে মুন্নাকে জিজ্ঞাসা করলেন মুন্না তুই কি চাস ? মানুষ হিসাবে বাঁচতে? নাকি তুই ঐ শুভাইয়ার মতো চিতা হয়ে জঙ্গল আগলাবি। মুন্না আরো তেলে বেগুনে জ্বলে উঠল। ও সাধুবাবাকে নোংড়া গালি দিয়ে বলে উঠলো যা পারিস কর, আমি ঐসব বুজরুকি বিশ্বাস করিনা। সাধুবাবা ওকে শেষ বারের মতন ভেবে নিতে বলাতেও ওর মত বদলালোনা, তখন রেগে সাধুবাবা বোললেন তবে তুই মরগে যা, থাক চিতা হয়ে,এই বলে এক মুঠো বালী মন্ত্র পড়ে ছুঁড়ে দিলেন মুন্নার গায়। সঙ্গে সঙ্গে মুন্না উধাও ওখানে কালো একটা চিতা, আর সেই গাছ তলার চিতাটা নেই।
এর পর সবাই চলে গেলো একে এক করে। আমি সাধুবাবাকে জিজ্ঞাসা করলাম ঐ চিতাটা শুভাইয়ার কি হোলো? সাধুবাবা বললেন আজ ও মুক্তি পেয়ে গেলো ওর জায়গায় মুন্না থাকবে আজথেকে জঙ্গলের পাহারা দার চিতা হয়ে, আবার যত দিন না কেউ নতুন করে এই ভাবে আসে তাছাড়া শুভাইয়া বদলেগেছে একদম, ও পশুপ্রেমী প্রকৃতি সচেতন দরদী হয়ে গেছে।

No comments:
Post a Comment